জাইরা ওয়াসিমকে দেখে মুসআব ইবনে উমায়েরকে (রা.) মনে পড়ে যায়


জীবনের প্রথম সিনেমা–যে সিনেমা দিয়ে বলিউডে পা রাখা–হলো ভারতের সবচেয়ে বড় হিট৷ বক্স অফিসে যেমন টাকা কামালো, সুনামও কুড়ালো বেশ। কো-স্টার কে? মি. পারফেকশনিস্ট খ্যাত আমির খান! এভাবেই শুরু হয়েছিলো জাইরার বলিউড সফর। তখন তিনি মাত্র ষোলো বছরের কিশোরী। আর এই কম বয়সেই অভিনয় দিয়ে জয় করে ফেলেন অনেকের মন৷ আর তাইতো একের পর এক ফিল্মের অফার আসতে থাকে তার কাছে। 


এবার পেলেন লিডিং রোল প্লে করার সুযোগ। একেবারে দ্বিতীয় সিনেমাতেই লিডিং রোল প্লে করার সুযোগ কজন পায়? বিপরীতে এবারও আমির খান। এবারের সিনেমায় জাইরার অভিনয় দক্ষতা মুগ্ধ করে সিনেমা ক্রিটিকদেরও। পান ফিল্মফেয়ার ক্রিটিক এওয়ার্ড। সেইসাথে মাত্র সতের বছর বয়সেই পান ন্যাশনাল ফিল্ম এওয়ার্ড। শাহরুখ খান তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, জাইরা খুব তাড়াতাড়ি বলিউডের কিংবদন্তি নায়িকাদের কাতারে চলে আসবে। 


সাল ২০১৯, ক্যারিয়ারের ৩য় সিনেমার শ্যুটিং শেষ করেছেন জাইরা। হাতে আছে অনেকগুলো সিনেমা। এর মাঝে একটি সিনেমা স্বয়ং বলিউডের কিং খান শাহরুখের সাথে৷ মাত্র ঊনিশ বছরেই জাইরা ছুঁয়ে ফেলেছিলেন সফলতার সর্বোচ্চ শিখর! এমন জীবন হলে আর কী লাগে? টাকা, খ্যাতি, এপ্রিসিয়েশন, গ্ল্যামার সবই আছে। 


কিন্তু এমন একটা সময়েও জাইরার মনে প্রশান্তি নেই। তার সারাক্ষণ মনে হতে থাকে কিছু একটা সমস্যা আছে। কিন্তু কী সেই সমস্যা সেটা তিনি জানেন না। ৩য় সিনেমার প্রমোশন করছেন, এই ইভেন্ট ঐ ইভেন্টে যাচ্ছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব ফ্রাস্টেশন কাজ করছে তার। 


মিশরের কায়রোতে বসে তিনি ভাবতে থাকেন, কী হলো তার? কেন তার মনে এই ফাঁকা ফাঁকা ভাব? কিছু একটা মিসিং তার লাইফে, কী সেটা? জাইরা বলেন, "আল্লাহ তাআলা মানুষকে ফিতরাতের ওপর সৃষ্টি করেছেন - একটা সহজাত অনুভূতি। এটা পুরোপুরি নষ্ট হয় না। এটা আমাদেরকে সবসময় একটা মেসেজ পৌঁছাতে চেষ্টা করে। কেন এমন হয় যে, কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে আমরা কষ্ট পাই? কেন এমন হয়, কাউকে সাহায্য করলে আমাদের ভালো লাগে? এটা ফিতরাতের কারণে। আর সেই ফিতরাত আমাকে জানাচ্ছিলো, কিছু একটা ঠিক নেই।" 


বেশ কিছুদিন ভাবার পর জাইরা স্থির হন। তার মনে হয়, তার মধ্যে একটা জিনিস মিসিং। আর সেটা হলো জ্ঞান (ইলম)। কিন্তু জ্ঞান তো অনেকরকমই হয়। কোন জ্ঞান লাগবে তার? মাথার মধ্যে বারবার ঘোরাতে থাকেন বিষয়টা। তারপর তার মনে হয়, একেবারে শুরু থেকেই শুরু করা যাক। যেখান থেকে আমার, আপনার, এই বিশ্বজগতের শুরু - জাইরা তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। 


জাইরা বলেন, "আমি তো আল্লাহকে বিশ্বাস করি। এটা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তারপর আমি ভাবতে লাগলাম, এমন তো হতে পারে না যে আল্লাহ কোনো কারণ ছাড়াই আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আমরা খাবো দাবো ফূর্তি করবো এজন্য তো তিনি আমাদের দুনিয়ায় পাঠাননি!" 


আস্তে আস্তে মাথার জট খুলতে থাকে জাইরার। একে একে সব প্রশ্নের উত্তর মিলতে থাকে তার। এরপর জাইরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর দেন। নিজেকে এবং আমাদেরকেও। আমরা কেন গাফেল হয়ে থাকি? আমরা কেন আল্লাহর কাছে ফিরি না? জাইরা বলেন, আমরা নিজেকে নিজে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখি। আমরা বলি, আল্লাহ তো আমাদের নিয়্যাত জানেন। আমরা যা-ই করি না কেন, আমাদের নিয়্যাত যদি ভালো থাকে, কর্ম মাইনে রাখে না। এই ভুল ধারণাটি আমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করে রাখে। তিনি আরো বলেন, আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। আমরা বলি, No one can judge me, Only Allah can judge me। আমরা কত বড় স্পর্ধা দেখাচ্ছি, আল্লাহকে আমাদের বিচার করার ভার দিচ্ছি, অথচ বিচারের জন্য কি আমরা প্রস্তুত? 


একসাথে অনেকগুলো বিষয় মাথায় আঘাত করে জাইরার। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। ছেড়ে দেবেন সিনেমা। আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছাবেন। আল্লাহর বান্দী হবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। সব সিনেমার অফার রিজেক্ট করে দেন। এমনকি খোদ শাহরুখের সাথে যেই সিনেমার অফারটি ছিলো, সেটিও। তারপর সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে দেন বলিউড ছাড়ার। 


পুরো ইন্ডাস্ট্রি হতভম্ব! কী বলে এই মেয়ে? কতোজন তো ২০-২৫ বছর সংগ্রাম করেও বলিউডে এই পজিশনে পৌঁছাতে পারে না যা এই মেয়ে ৩ বছরে পৌঁছেছে! এমন একটা পীক পয়েন্টে এসে বলিউড ছেড়ে দেবে! কিন্তু, তারা তো জানে না, যে একবার ঈমানের স্বাদ পেয়েছে, তাকে দুনিয়ার স্বাদ গাফেল করতে পারে না। সিনেমা ছেড়ে দেন জাইরা। গ্ল্যামার ছেড়ে দেন। টাকা-পয়সা ছেড়ে দেন। হয়ে যান গুরাবা, হয়ে যান আল্লাহর বান্দী, ফিরে আসেন নিজের ফিতরাতে। এমনকি নিজের অভিনীত তৃতীয় সিনেমাটিও তিনি দেখেননি আজ অবধি! ভাবতে পারেন? কেমন আত্মত্যাগ! 


জাইরাকে দেখে মনে পড়ে যায় মুসআব ইবনে উমায়েরকে (রা.)। যিনি ছিলেন মক্কার সেলেব্রিটি। প্রতিনিয়ত জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে আবৃত থাকতো যার দেহ। যার পারফিউম এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়তো। সেই পারফিউম নাকে আসলে মানুষ বুঝতে পারতো, এই আসছে মুসআব। সেই মুসআব ইসলামের সংস্পর্শে এসে পুরোপুরি বদলে গেলেন। সব সাজসজ্জা আর বিলাসিতা ছেড়ে দিয়ে হয়ে গেলেন মাটির মানুষ। যেই মুসআবের জামা মাটিতে ঝুলতো, সেই মুসআব যখন শহীদ হলেন তার কাফন হলো ছোট্ট একটি কাপড়। মাথা ঢাকা গেলে পা ঢাকা যায় না, পা ঢাকা গেলে মাথা ঢাকা যায় না। কীসের আশায় সেলেব্রিটি মুসআব সব ছেড়েছুড়ে দিলেন? কী পেলেন তিনি? 


মুসআব পেয়েছিলেন আল্লাহকে। যে আল্লাহকে পেলো, সে কী হারালো? কিছুই হারাননি জাইরাও। তাদের এই সাময়িক হারানো যে "সব পেয়েছির দেশে" যাওয়ার টিকিট খরিদ করার সামান্য খরচ। 


...


|| জাইরা ওয়াসিমকে দেখে মুসআব ইবনে উমায়েরকে (রা.) মনে পড়ে যায় || 

- আসিফ মাহমুদ

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. আমি মুসআব ইবনে উমায়েরের জীবনি যখন পড়েছি আমার দু চোখ দিয়ে কেবল পানি পড়েছে।

    ReplyDelete