মুহাম্মাদ (ﷺ) এর নবুয়তের দাবি প্রত্যাখ্যান করতে হলে আপনাকে ধরে
নিতে হবে যে, তিনি মিথ্যা বলছিলেন অথবা বিভ্রমে ভুগছিলেন। কেননা, তিনি যদি সত্য না
বলে থাকেন, তবে তিনি সচেতন কিংবা অচেতনভাবে মিথ্যা বলেছেন। সচেতন মিথ্যা তো মিথ্যাই, অচেতন মিথ্যার কারণ হিসেবে আমরা বিভ্রমকে চিহ্নিত করি। তাই, এই দুটো পয়েন্ট আমরা বিশেষভাবে
পর্যালোচনার চেষ্টা করবো, মুহাম্মাদ (ﷺ) আদৌ নবী ছিলেন কী-না বোঝার জন্য।
মুহাম্মাদ (ﷺ) কি মিথ্যা বলছিলেন?
মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে আল-আমিন ডাকা
হতো, যার অর্থ বিশ্বস্ত। লোকেরা তাঁর কাছে আমানত গচ্ছিত রাখতো। নবুয়তের আগের ৪০
বছরে তিনি মিথ্যে বলেছেন, এমন কোনো বক্তব্য ইতিহাসের পাতায় নেই। ভাবছেন এটা আমার মনগড়া
কথা? আচ্ছা একজন লোক মিথ্যাবাদী কী-না জানতে হলে আপনি কার
কাছে যাবেন? অবশ্যই তাঁর ঘোর শত্রুদের কাছে যাবেন। কেননা শত্রুরাই তাঁর সকল দুর্বলতা
ও দোষের খবর রাখবে।
শত্রুরাই আপনাকে জানিয়ে দেবে তিনি মিথ্যাবাদী নাকি সত্যবাদী। চলুন, মুহাম্মাদের (ﷺ) শত্রুদের কাছেই শুনে আসি তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন
কী-না।
·
আবু জেহেল ছিলো ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু। সে মুহাম্মাদকে (ﷺ) সবচেয়ে বেশি আঘাত ও কষ্ট দিয়েছে। একাধিকবার তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। মুহাম্মাদ (ﷺ) যদি মিথ্যাবাদী হতেন, তবে সবার
আগে এই আবু জেহেলেরই সাক্ষ্য পাওয়া যেতো সেই ব্যাপারে। অথচ, সে কী বলেছে জানেন? সে বলেছে, “মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে
মিথ্যাবাদী বলি না, বরং তুমি যা নিয়ে এসেছো সেটাকে মিথ্যা বলি।” (১) এই বিষয়ে কুরআনে কারীমেও একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। (২) এখন
আপনারা বলতে পারেন, এটি দিয়ে কী প্রমাণিত হয়? মূলত এটি দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়তের পূর্বে মিথ্যাবাদী ছিলেন না। সবাই তাকে সত্যবাদী হিসেবেই জানতো ও মানতো। আবু জেহেলের সাক্ষ্য সেটাই বলছে।
·
ইসলামের অন্যতম বড় শত্রু ছিলো আবু
সুফিয়ান। আবু সুফিয়ান মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহন করে। কিন্তু, এর পূর্বে সে ইসলামের বিরুদ্ধে বিবিধ
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো। মুহাম্মাদের (ﷺ) শত্রুদের লিস্ট করা হলে তার নাম মোটামুটি টপ ফাইভে
স্থান পাওয়ার যোগ্য। সেই আবু সুফিয়ানের মুখেই আমরা মুহাম্মাদের (ﷺ) সত্যবাদী হওয়ার সাক্ষ্য দেখে আসি? মুহাম্মাদ (ﷺ) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলামের দাওয়াতী
চিঠি পাঠালে তিনি আবু সুফিয়ানসহ কিছু কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠান। রোম সম্রাটের সাথে আবু সুফিয়ানের সেই বিখ্যাত
কথোপকথনটি আবু সুফিয়ান নিজেই ইসলামগ্রহণের পর বর্ণনা করেছেন যা বুখারী শরীফে
এসেছে। সেই লম্বা হাদীসে হিরাক্লিয়াস এই নতুন নবুয়ত দাবী করা মানুষটি সম্পর্কে আবু
সুফিয়ানকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন। সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি ছিলো, “তিনি
(মুহাম্মাদ ﷺ) যখন থেকে এসব
কথা বলছেন, তার পূর্বে কি তাঁকে তোমরা কোনো মিথ্যার সঙ্গে জড়িত দেখেছো?” আবু
সুফিয়ান বললেন, “না।” (৩)
পাঠক লক্ষ্য করুন, এই হচ্ছে মুহাম্মাদের (ﷺ) সেই সময়কার সবচেয়ে ঘোরতোর শত্রু আবু সুফিয়ান।
হিরাক্লিয়াসের দরবারে তিনি গিয়েছিলেন, মুহাম্মাদকে (ﷺ) মিথ্যা নবী প্রমান করতে ও দূর্নাম করতে। তিনিও এটা
অকপটে স্বীকার করলেন যে মুহাম্মাদ (ﷺ) মিথ্যাবাদী ছিলেন না।
·
প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আয়াত অবতীর্ণ হলে মুহাম্মাদ (ﷺ) সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে
চিৎকার করে বললেন, “ইয়া সাবাহা!” তৎকালীন সময়ে এটা একটা সতর্কবাণী হিসেবে পরিচিত
ছিলো। তখন যারা ডাক শুনতে পেল, তারা এগিয়ে এলো। কুরাইশদের প্রায় সবাই একত্র হওয়ার
পর মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁদেরকে বললেন, “আমি যদি তোমাদেরকে বলি, এই
পাহাড়ের পেছনে এক সৈন্যবাহিনী অপেক্ষা করছে তোমাদেরকে অতর্কিত হামলা করার জন্য,
তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?” তারা সমস্বরে বলে উঠলো, “আমরা তো আপনাকে কখনো মিথ্যা
বলতে শুনিনি।” তখন মুহাম্মাদ (ﷺ) বললেন, “আমি এসেছি তোমাদেরকে
এক কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করতে। যদি তোমরা বিশ্বাস না করো, তাহলে তা তোমাদের
উপরে আপতিত হবে।” তারপর তিনি ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এরপর আবু লাহাব বললো,
“তোমার দিন মাটি হোক। তুমি এসব বলতে আমাদের ডেকেছো?” (৪) এই ঘটনার মাধ্যমে কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, তা হলো—কুরাইশরা মুহাম্মাদকে
(ﷺ) সত্যবাদী বলেই জানতো। এজন্যই “আমরা তো আপনাকে কখনো
মিথ্যা বলতে শুনিনি”—তাদের অকপট সাক্ষ্য। আবার একটি বিষয় ইসলামের ঘোর শত্রু আবু
লাহাবের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয়। তা হলো— সেও মুহাম্মাদকে (ﷺ) মিথ্যাবাদী
বলতে নারাজ। মূলত, সে আযাবের কথা শুনে বিরক্ত। দুনিয়ার মোহ কাটানো এসব নীতিকথা
শুনতে কার-ই বা ভালো লাগে?
মুহাম্মাদের (ﷺ) শত্রুদের মুখেই তাঁর
সত্যবাদী হওয়ার সাক্ষ্য পেলাম। এর চাইতে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য আর কি হতে পারে?
এখন আপনারা বলতে
পারেন, এটা তো নবুয়তের আগের কথা! হয়তোবা তিনি ৪০ বছর বয়স অবধি সত্যবাদী ছিলেন।
এরপর থেকে তিনি মিথ্যা বলা শুরু করেছেন, নবুয়তের মিথ্যা নাটক সাজিয়েছেন। আচ্ছা,
নবুয়তের মিথ্যা নাটক করতে গেলে দৈনিক কী পরিমাণ মিথ্যা বলতে হয়? কল্পনার অযোগ্য,
তাইনা? প্রতিটা মিনিট মিথ্যার ওপর থাকতে হয়। আর এই মিথ্যামিথ্যি নবী হওয়ার জন্য
প্রয়োজন সুদীর্ঘ অনুশীলন, যা গত ৪০ বছরে তিনি একমূহুর্তের জন্যও করেননি! কোনো
অনুশীলন ছাড়াই তিনি খুব সূচারুভাবে নবী হওয়ার নাটক করলেন পরবর্তী দীর্ঘ ২৩ বছর,
হাজার হাজার মানুষ তার এই মিথ্যে ধরতে পারলো না! আচ্ছা, এই কথার নাহয় আপনি পাল্টা
যুক্তি দেখাতে পারেন এই বলে যে—তিনি হেরা গুহায় গিয়ে অনুশীলন করেছেন। হেরা গুহায়
তিনি ধ্যানমগ্ন থেকেছিলেন মাত্র কয়েক মাস। এই কয়েক মাসে তিনি কুরআন—যা আরবী ভাষা
সাহিত্যের অনন্য নিদর্শন, অলৌকিক আলোচনায় পরিপূর্ণ, নবীদের গল্পের নিঁখুত
বর্ণনাসমৃদ্ধ, মানবজাতির জন্য চমৎকার সংবিধান, বাইবেলের ভুল শুধরে দেয়া অনন্য
কিতাব—রচনা করে ফেললেন? সেই সাথে অসংখ্য হাদীস—যেগুলো বৈজ্ঞানিক, নৈতিকতার
পথপ্রদর্শক, আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের মূলনীতি এবং অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিপূর্ণ—রচনা
করে ফেললেন? (৫) আচ্ছা ধরে নিলাম তিনি মিথ্যাই বলেছেন। কিন্তু
কেন? ৪০ বছর যাবত যিনি মিথ্যা বলেননি, সেই মানুষ ৪০ বছরের পর হুট করে কেন মিথ্যা
বলবেন? এক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ আসতে পারে। পয়েন্ট আকারেই বলি।
§ সম্পদ
§ নারী
§ নেতৃত্ব
§ সমাজ পুনর্গঠন
সম্পদ
আচ্ছা বলুনতো, নবুয়তের আগে মুহাম্মাদ (ﷺ) ধনী ছিলেন নাকি গরিব?
উত্তরটা সহজ। তিনি ধনী ছিলেন। খাদিজা (রা) ছিলেন সম্পদশালী নারী। বিয়ের পর এই
বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। তিনি বাণিজ্য করতেন সিরিয়ায় গিয়ে, তাঁর সম্পদের অভাব ছিলো
না। বরং উল্টো চিত্র দেখা যায় নবুয়তের পর। নবুয়তের পর তিনি স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য
বরণ করে নিয়েছিলেন। কয়েকটি উদাহরন দেয়া যায়।
·
ক্বাতাদাহ (রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, “আমরা আনাস ইবনে
মালিকের কাছে গেলাম। তাঁর বাবুর্চি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। তিনি (আনাস) বললেন, “খাও,
নবী (ﷺ) আল্লাহর
সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাতলা রুটি দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। এবং তিনি
ভুনা বকরীও কখনো চোখে দেখেননি।” (৬)
·
আবিস (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি আয়িশাহকে (রা)
জিজ্ঞেস করলাম... ... তিনি (আয়িশাহ রা.) হেসে বললেন, “মুহাম্মাদ
(ﷺ) আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পরিবার
পরিজন এক নাগাড়ে তিনদিন তরকারীসহ গমের রুটি পেট ভরে খাননি।” (৭)
·
আয়িশাহ (রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি একবার
উরওয়াহকে (রা) বললেন, “বোন পুত্র, আমরা দু’মাসে তিনটি
চাঁদ দেখতাম। কিন্তু এর মাঝে আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) ঘরে আগুন জ্বলতো না। উরওয়াহ
বললেন, “আপনারা কীভাবে দিনাতিপাত করতেন?” তিনি বললেন, “কালো দুটো বস্তু। খেজুর আর পানি।”
(৮)
·
ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “ইন্তেকালের সময় রাসূল (ﷺ) দিনার-দিরহাম কিংবা দাস-দাসী
কোনোটাই রেখে যাননি; তিনি রেখে গিয়েছিলেন একটি বর্ম—যা ত্রিশ সা’ খাদ্যদ্রব্যের
জামানত হিসেবে এক ইয়াহুদীর কাছে সংরক্ষিত ছিলো। (৯)
·
আবু সালিহ (রা) বলেন, নবীকে (ﷺ) একবার খাওয়ার জন্য ডাকা হলো।
খানা শেষে তিনি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে বললেন, “অমুক দিন থেকে আমি পেটভরে উষ্ণ
খাবার খাইনি।” (১০)
·
আমর ইবনে মুহাজির (রহঃ) বলেন, উমার ইবনে আবদুল আজিজের
(রহঃ) একটি ঘর ছিলো—যেখানে তিনি প্রায়শই নির্জন সময় কাটাতেন। ঘরটিতে ছিলো রাসূলের (ﷺ) কিছু জিনিসপত্র। সেখানে ছিলো
খেজুর পাতার বিছানাসহ একটি খাট, কাঠের একটি অমসৃণ পাত্র—যা থেকে তিনি পানি পান
করতেন, একটি ভগ্ন-মাথা মাটির পাত্র—যেখানে তিনি বিভিন্ন জিনিস রাখতেন, আর একটি
চামড়ার বালিশ—যার ভেতর ছিলো খেজুর গাছের আঁশ কিংবা রাবারসদৃশ ধুলামলিন সস্তা মখমল।
দীর্ঘদিন ব্যাবহারের ফলে বালিশটিতে রাসূলের (ﷺ) চুলের ছাপ লেগে আছে। (কুরাইশদের দেখিয়ে) উমার ইবনে
আবদুল আজীজ (রহঃ) বলতেন, “ওহে কুরাইশ, এ উত্তরাধিকার তো সেই ব্যক্তির যার বদৌলতে
আল্লাহ তোমাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি দান করেছেন! তোমরা যা দেখতে পাচ্ছো—তা রেখেই
তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন!” (১১)
·
আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, “জীর্ণতা ঈমানের অংশ,
জীর্ণতা ঈমানের অংশ, জীর্ণতা ঈমানের অংশ।” বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, “আমি
আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম—জীর্ণতা কী? তিনি জবাব দিলেন—জীর্ণতা হলো পোশাকে
বিনয়।” (১২)
·
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) এই বলে দু’আ করতেন, “হে
আল্লাহ! মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু রিযকের ব্যবস্থা করে
দাও।” (১৩)
·
সাবিত (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পরিবারের সামনে অন্নাভাব
দেখা দিলে তিনি তাঁর ঘরের বাসিন্দাদেরকে এভাবে ডাকতেন, “ওহে ঘরের বাসিন্দাগণ,
সালাত আদায় করো, সালাত আদায় করো।” (১৪)
·
ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, ‘উমার ইবনে খাত্তাব (রা)
রাসূলের (ﷺ) গৃহে
প্রবেশ করলেন; নবী (ﷺ) তখন একটি মাদুরে শোয়া। তাঁর পার্শ্বদেশে মাদুরের
ছাপ লেগে গিয়েছিলো। তা দেখে উমার (রা) বললেন, “হে আল্লাহর নবী! আপনি যদি এর চেয়ে
একটু নরম বিছানা গ্রহণ করতেন!” এটা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন, “এ দুনিয়ার সাথে আমার
কী সম্পর্ক? এ দুনিয়ার সাথে আমার দৃষ্টান্ত হলো নিছক এমন এক অর্শ্বারোহীর ন্যায় যে
প্রচণ্ড গরমের এক দিনে ভ্রমণে বের হয়ে দিনের কিছুক্ষণ একটি গাছের ছায়ার নিচে আশ্রয়
গ্রহণ করলো। তারপর বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।” (১৫)
·
ইকরিমা (রহঃ) বলেন, “ফাতিমাকে (রা) বিয়ে দেয়ার সময় রাসূল (ﷺ) তাঁকে খেজুর গাছের ছাল দিয়ে
তৈরি একটি বিছানা, আঁশভর্তি চামড়ার একটি বালিশ ও কিছু পনির উপহার দিয়েছিলেন।” (১৬)
·
নুমান ইবনে বশীর (রহঃ) একবার এক বক্তৃতায় বলেন, “মানুষকে
দুনিয়া কীভাবে পেয়ে বসেছে—তা উল্লেখ করে উমার (রা) বলেছেন, ‘আমি একদিন
রাসূলুল্লাহকে (ﷺ) ক্ষুধার
জ্বালায় ন্যুব্জ হয়ে যেতে দেখেছি। পেট ভরার মতো নিম্নমানের খেজুরও সেদিন তার নিকট
ছিলো না’।” (১৭)
·
আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, “ফাতিমা (রা) রাসূলকে (ﷺ) এক ছিলকা যবের রুটি
খাওয়ালেন। রাসূল (ﷺ) বললেন, “এটিই প্রথম খাবার যা তোমার পিতা গত
তিনদিনের মধ্যে খেলেন।” (১৮)
ওপরের ঘটনাগুলো থেকে আপনার বুঝতেই পারছেন, নবুয়তের পর মুহাম্মাদ (ﷺ) কেমন অভাব-অনটনের মধ্যে
দিনাতিপাত করেছেন। তিনি ছিলেন ভীষণ রকম দুনিয়াবিমুখ! দুনিয়া যে কতোটা তুচ্ছ আর
দুনিয়ার বিলাস যে কতোটা ক্ষণস্থায়ী—সাহাবায়ে কেরামকে তিনি এই কথাটাই অনেক বেশি
বলতেন। দুনিয়ার তুচ্ছতা, সম্পদ বিমুখ হওয়া, দারিদ্র্যকে ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়ে
তাঁর অসংখ্য হাদীস আছে। (১৯) এছাড়া রাসূল (ﷺ) কতোটা
দুনিয়া ও সম্পদবিমুখ ছিলেন তার কিছুটা ধারণা পাবেন ইতিহাসখ্যাত আলিম আহমাদ বিন
হাম্বল (রহঃ) এর বিখ্যাত বই ‘কিতাবুয যুহদ’ পড়লে। বইটি মাকতাবাতুল বায়ান প্রকাশনী
থেকে ‘রাসূলের চোখে দুনিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
নারী
মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন
সুপাত্র। তাঁর সৌন্দর্য্য ছিলো অতুলনীয়। (২০) বংশে তিনি ছিলেন
উচ্চ। আচরণে ছিলেন অতুলনীয়। এমন মানুষের জন্য কি নারীর অভাব হতো? মুহাম্মাদ (ﷺ) কেমন
সুপাত্র ছিলেন জানেন? যখন তাঁর ঘোরতোর শত্রু আবু সুফিয়ান তার বোনের সাথে
মুহাম্মাদের (ﷺ) বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব পেলো, তখন সেও আনন্দিত
হয়ে পড়লো। মুহাম্মাদ (ﷺ) চারিত্রিক গুনাবলিতেও অনন্য ছিলেন। নবুয়তের
পূর্ববর্তী আরব সম্পর্কে তো আপনাদের টুকটাক ধারণা থেকে থাকবে। সেই ‘আইয়্যামে
জাহিলিয়া’ নামে পরিচিত আরবে সবচেয়ে জঘন্য ছিলো তাদের যৌনতা। তখন সমাজে চার ধরণের
সম্পর্ক প্রচলিত ছিলো। এক—স্বাভাবিক বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক। দুই—পতিতালয় যা বৈধ
ছিলো। তিন—একজন নারী অনেকগুলো পুরুষের সাথে মিলিত হতো; পরবর্তীতে গর্ভবতী হলে সে
সবাইকে একসাথে ডেকে পাঠিয়ে যেকোনো একজনকে নিজের সন্তানের বাবা হিসেবে মনোনীত করতো।
চার—স্বামী তার স্ত্রীকে কোনো একজন সম্ভ্রান্ত পুরুষের সাথে সঙ্গম করতে পাঠাতো
সম্ভ্রান্ত জাতের সন্তান পাওয়ার জন্য। ভাবতে পারছেন? কতোটা কলুষিত একটা
সমাজব্যবস্থা ছিলো! সেই জঘন্য সমাজে মুহাম্মাদ (ﷺ) যৌবনের পঁচিশটি বছর পার
করেছেন অথচ তার গায়ে জাহিলিয়াতের এক ফোঁটা কালি লাগে নি। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে
নারীঘটিত কোনো খারাপ রিপোর্ট পাওয়া যায় না এই সুদীর্ঘ সময়েও। আবার দেখুন, এই টগবগে
যুবক—যিনি ছিলেন অসাধারণ সৌন্দর্য্যের অধিকারী, উচ্চবংশীয় সুপাত্র—চাইলে যে কাউকে
বিয়ে করতে পারতেন। যেকোনো উচ্চবংশীয়, সুন্দরী, যুবতী, কুমারী নারী তিনি অনায়াসে
বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু, তিনি বিয়ে করলেন চল্লিশ বছর বয়সী খাদিজাকে (রা) যাঁর
ইতোপূর্বের দুটো বিয়ে হয়েছিলো। খাদিজার (রা) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (ﷺ) আর কোনো
বিয়ে করেননি। তাঁদের বিয়ের পঁচিশ বছরের মাথায় খাদিজা (রা) মৃত্যুবরণ করেন। তার
মানে হলো—মুহাম্মাদের (ﷺ) বয়স পঞ্চাশ বছর হওয়া অবধি অর্থাৎ যৌবনের পুরোটাই
তিনি এক স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়েছেন। এটা ঠিক যে, জীবনের শেষ দশকে মুহাম্মাদ (ﷺ) অনেকগুলো
বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু, সেগুলোর পেছনে তাঁর বাসনা ছিলো না। বরং, আল্লাহর নির্দেশ,
সম্পর্কোন্নয়ন, রাজনৈতিক কৌশল ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ বিয়েগুলো করেছিলেন। স্বল্প
করে কিছু বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়।
মুহাম্মাদ (ﷺ) নিজের
ঘনিষ্ঠ দুই সাহাবী আবু বকর (রা) ও উমার (রা) এর কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। উসমান (রা)
এবং আলীর (রা) কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এতে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ
হয়েছিলো। তিনি অসহায় নারীদের বিয়ে করেছেন। যেমন—বিধবা ও বৃদ্ধা সাওদা (রা) ও তাঁর
অনেকগুলো সহায়হীন সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য, উহুদ যুদ্ধে স্বামী শহীদ হওয়া
বিধবা উম্মু সালামাকে (রা) সহায় দেয়ার জন্য, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ানের
(রা) স্বামী মূরতাদ হওয়ার পর মারা গেলে তাঁকে সহায়তা করার জন্য বিয়ে করেন। জুওয়াইরিয়াকে
(রা) বিয়ে করার কারণে বনু মুস্তালিক গোত্রের সবাই মুসলিম হয়ে যায়, এটা একটা চমৎকার
রাজনৈতিক কৌশল ছিলো। যয়নব বিনতে খুযাইমার (রা) পূর্বে তিনজন স্বামী ছিলেন; তৃতীয়
স্বামী আবদুল্লাহ বিন জাহশ (রা) উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলে মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁকে বিয়ে
করে নেন। এছাড়া পালক পুত্র যায়েদের (রা) তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী জাইনাবকে (রা) বিয়ে
করে তিনি ইসলামের একটি বিধান রদ করেন যা আরবে খুব প্রচলিত ছিলো। তারা পালকপুত্রকে
আপন পুত্রের মত মনে করতো। এই বিয়ের মাধ্যমে পালকপুত্র ও আপন পুত্রের মাঝে সুস্পষ্ট
তফাৎ সৃষ্টি করা হয়।
পাঠক, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন—মুহাম্মাদ (ﷺ) যাঁদেরকে বিয়ে করেছেন তার
মধ্যে আয়িশা (রা) ছাড়া আর কেউ কুমারী ছিলেন না। বেশিরভাগেরই আগে এক বা একাধিক বিয়ে
হয়েছে, কয়েকজন বৃদ্ধাও ছিলেন। মুহাম্মাদের (ﷺ) নারীলোভই যদি থাকতো, তবে
তিনি কেন কুমারী মেয়ে, অবিবাহিতা মেয়ে বিয়ে করলেন না? আর তিনি বিয়েগুলো যেহেতু
জীবনের শেষ দশকে করেছিলেন, সে হিসেবে তখন তার বয়স ছিলো ৫৩-৬৩ বছর। এই বয়সে এসে যৌন
আবেদন খুব একটা থাকে না, এটা যে কেউ বলতে পারে। আর এই বিয়েগুলোর পেছনে যথেষ্ট
হিকমাহ-ও ছিলো।
মুহাম্মাদ (ﷺ) ব্যক্তিগত
জীবনে কেমন ছিলেন, পারিবারিক জীবনে চলার নিয়মাবলী, বিভিন্ন আমল এসব সম্পর্কে
উম্মাহকে কে জানাবে? স্ত্রীগণ তো তাঁকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন, তাই তাঁরাই এই
ব্যাপারে উম্মাহকে ভালো জানাতে পারবেন। এছাড়া, নারীদেরকে দ্বীন কে শেখাবে? উম্মুল
মুমিনীনরাই নারীদেরকে দ্বীনের বিষয়াদি জানাতেন। আয়িশা (রা) হাদীস বর্ণনাকারীদের
মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। তিনি আরো ছিলেন ফিক্বহশাস্ত্রে ভালো। তাই বিভিন্ন বিষয়ে
মাসআলা বলতে পারতেন। মুহাম্মাদের (ﷺ) সংস্পর্শে থাকার কারণে তাঁর
জন্য ব্যাপারটা আরো সহজ হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য প্রজ্ঞা রয়েছে মুহাম্মাদের (ﷺ) বিয়েগুলোর
পেছনে যা দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণ করে, তিনি নারীলোভী ছিলেন না। (২১)
নেতৃত্ব
তবে কি তিনি নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য নবুয়তের অভিনয় করেছিলেন? যারা আরবের
ইতিহাস জানেন, তারা জানবেন কুরাইশ ছিলো আরবের সবচেয়ে
সম্ভ্রান্ত গোত্র। আর কুরাইশের মাঝে বনু হাশিম ছিলো নেতৃস্থানীয়। মুহাম্মাদের (ﷺ) দাদা আবদুল
মুত্তালিব ছিলেন আরবে অত্যন্ত সম্মানিত। তিনি ছিলেন নেতা। সবাই তাকে একবাক্যে
মান্য করতো। আবদুল মুত্তালিবের পর তার ছেলে ও মুহাম্মাদের (ﷺ) চাচা আবু
তালিবও নেতৃস্থানীয় ছিলেন। সবাই তাকে নেতা মানতো ও সম্মান করতো। তিনি যতদিন জীবিত
ছিলেন, তার সম্মানের কারণেই মুহাম্মাদকে (ﷺ) খুব বেশি
ক্ষতি করতে পারেনি মক্কার কাফিররা। অর্থাৎ, বনু হাশিম
এমনিতেই নেতৃস্থানীয় ছিলো। আর বনু হাশিমের একজন হিসেবে মুহাম্মাদও (ﷺ) পরবর্তী
নেতা হতেন। শুধু বংশ নয়, তাঁর বৈশিষ্ট্যও নেতাসুলভ ছিলো।
মানুষ তাঁকে পছন্দ করতো, আমানতদার মনে করতো এবং মিমাংসাকারীও
বানাতো। একবার কুরাইশরা কাবাকে পুনঃ নির্মাণ করলো। কিন্তু নির্মাণের পর হাজরে
আসওয়াদ বসানো নিয়ে গোত্রগুলোর মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে গেলো। কে এই পাথর বসানোর
সৌভাগ্য অর্জন করবে তা নিয়ে বাকবিতণ্ডায় একেবারে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলো।
শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলো পরবর্তী দিন সবার আগে যে মাসজিদুল হারামে প্রথম প্রবেশ
করবে, সে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। আল্লাহর অপার মহিমায়
মুহাম্মাদ (ﷺ) হারামে প্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখেই সকলে
চিৎকার করে উঠলো আর বললো, “আমাদের বিশ্বাসী, আমরা সকলেই এর উপর সন্তুষ্ট, তিনিই মুহাম্মাদ।”
তারপর মুহাম্মাদকে (ﷺ) বিষয়টি মিমাংসার দায়িত্ব দেয়া হলো। এবং তিনি
চমৎকার এক মিমাংসা করলেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তাতে পাথর রেখে চাদরের একেক কোণা
একেক গোত্রকে ধরতে বললেন। এভাবে সব গোত্রের অংশগ্রহণে হাজরে আসওয়াদ কাবায় স্থাপন
করা হলো এবং উদ্ভুত বিবাদের মিমাংসা হয়ে গেলো। (২২)
এই ঘটনাটি লক্ষ্য করলে বুঝবেন কুরাইশরা মুহাম্মাদের (ﷺ) নেতৃত্বে অসন্তুষ্ট হওয়া তো
দূরে থাক, বরং খুশি হতো। আর তাঁর নেতৃত্বের ও মিমাংসার
চমৎকার গুণও ছিলো। তিনি ছিলেন আল-আমিন, লোকে তাঁর কাছে আমানত রাখতো। এরকম একজন মানুষ যাঁর বংশমর্যাদা আছে,
নেতৃত্বের গুণ আছে, মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা
আছে, সে নেতা হওয়ার জন্য কেন নবুয়তের অভিনয় করবে?
আরেকটি বিষয় ভাবুন, নেতা হতে গেলে জনগণের ভাষা বুঝতে হয়। তাদের মনের কথাটি
বলতে হয়। তাদের আবেগ, অনুভূতির বিপরীতে গিয়ে নেতা হওয়া যায়
না। নেতাদের মন জয় করতে হয়। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত দেয়া কি নেতৃত্ব
হাসিলের উত্তম কোনো পন্থা বলে আপনি মনে করেন? মোটেই না।
কিন্তু মুহাম্মাদকে (ﷺ) দেখুন, উনি কী করেছিলেন?
উনি তৎকালীন আরবদের ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন। যেই
মূর্তিপূজা তাদের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, সেই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তিনি
দাঁড়ালেন। নেতৃত্বের আগ্রহ থাকলে তিনি কি এমন আত্মঘাতি কাজ করতেন?
প্রিয় পাঠক, একজন মানুষ এইসব দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তো মিথ্যা
বলবে তাই না? যদি স্বার্থসিদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ তাকে দেয়া হয়, তবে তো সে সাত-পাঁচ
না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সুযোগ দেয়া হয়েছিলো তাঁকে। সম্পদ, নারী, নেতৃত্ব তিনটিই
অফার করা হয়েছিলো।
ঘটনাটি এমন যে, একদিন মুহাম্মাদ (ﷺ) কাবার চত্ত্বরে বসেছিলেন। এই সময় উতবাহ ইবনে
রাবীয়াহ তাঁর কাছে আসে। সে বলে, “হে ভ্রাতুষ্পুত্র, এ ব্যাপারে তুমি যা নিয়ে আগমন
করেছো, তার উদ্দেশ্য যদি হয় এটা যে, তুমি কিছু ধন-সম্পদ অর্জন করতে চাও তাহলে আমরা
তোমাকে এত বেশি ধন-সম্পদ একত্রিত করে দেবো যে, তুমি আমাদের সবার চেয়ে অধিক
ধন-সম্পদের মালিক হবে। কিংবা তুমি যদি এটা চাও যে, মান-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি
তোমার কাম্য তাহলে আমাদের নেতৃত্ব তোমার হাতে অর্পণ করে দেবো এবং তোমাকে ছাড়া কোনো
সমস্যার সমাধান কিংবা মিমাংসা আমরা করবো না। কিংবা যদি এমনও হয় যে, তুমি রাজা-বাদশাহ
হতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের সম্রাটের পদে অধিষ্ঠিত করে দিচ্ছি।” (২৩)
অন্য একটি বর্ণনায় আছে, তারা তাঁকে আরবের যেই নারী চায়, তার সাথে বিয়ে
দেয়ার অফার করেছিলো। (২৪) কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ) তাদের
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
এ থেকে কী বোঝা যায়? এ থেকে বোঝা যায় না তাঁর সম্পদের লোভ ছিলো, না
নারীর, না নেতৃত্বের? তবে কী? কেন তিনি নবুয়তের মিথ্যা নাটক করেছিলেন? কী কারণ আর
থাকতে পারে?
সমাজ-সংস্কার
কেউ কেউ এও বলে থাকেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সমাজ-সংস্কারের উদ্দেশ্যে
মিথ্যা বলেছিলেন। আরবের লোকেরা তখন পাপাচারে নিমজ্জিত ছিলো। তাই তাদেরকে পাপাচার
থেকে দূরে সরিয়ে আলোকিত সমাজ, সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ) নবী হওয়ার
নাটক করছিলেন। ভালো যুক্তি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করার
কী প্রয়োজন ছিলো? তাঁর নবুয়তী জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে পাঠক দেখবেন, মাক্কী জীবনের
প্রায় পুরো সময়টাই তিনি তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ (রব হওয়ার ক্ষেত্রে, ইবাদাতের
ক্ষেত্রে এবং গুণের ক্ষেত্রে) প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিয়েছেন। সমাজ-সংস্কারের জন্য তো
আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার বাদ দিয়ে অন্য ভালো কাজগুলোর দাওয়াত দিতে পারতেন আর
কাফিররা সেটা অনায়াসে মেনেও নিতো। এইযে সূরা কাফিরুন নাযিলের প্রেক্ষাপটটাই দেখুন।
আসওয়াদ বিন মুত্তালিব, ওয়ালীদ বিন মুগীরা, উমাইয়া বিন খালাফ এবং আস বিন ওয়ায়িল
সাহমী মুহাম্মাদের (ﷺ) নিকট এসে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিলো। এর মধ্যে একটি
হলো—তারা মুহাম্মাদের (ﷺ) রবের ইবাদাত করবে, বিনিময়ে মুহাম্মাদকেও (ﷺ) তাদের রবের
ইবাদাত করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে সূরা কাফিরুনের আয়াত নাযিল হয়। “বল, হে কাফিররা!
তোমরা যার ইবাদাত করো, আমি তার ইবাদাত করি না” (২৫) আবার
তারা দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাব করে—যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) একবছর তাদের রবের ইবাদাত
করেন, তাহলে তারা আল্লাহর ইবাদাত করবে। তৃতীয়ত, তারা কুরআনের কিছু অংশ পরিবর্তন
করার প্রস্তাবও দিয়েছিলো। (২৬) খেয়াল করুন, কেবলই সমাজ-সংস্কার
যদি উদ্দেশ্য হতো, তবে তো কাফিরদের এই প্রস্তাব মেনে নেয়ায় মুহাম্মাদের (ﷺ) কোনো
সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু না, তিনি তা মেনে নেন নি। তিনি তাঁর দাওয়াতে অটল
ছিলেন। ‘আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোনো ইলাহ নেই’ এই একটি কথাকে সমাজে প্রতিষ্ঠত
করার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন—যা সমাজ-সংস্কার কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার সাথে
মোটেই সম্পর্কিত না। শুধুমাত্র সমাজ-সংস্কারই যদি উদ্দেশ্য হতো, তবে তিনি লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহর দাওয়াতের জন্য রক্ত ঝরালেন কেন?
একটা উদাহরণ দিয়ে আলাপ শেষ করি। ধরুন,
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদের আবেগে কাঁপছে
দু’দেশ। ভারতের দিল্লীতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হাজার মানুষের মিছিল হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ একদল লোক গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। এমন অবস্থায় যদি
ভারতে বসবাসরত কোনো পাকিস্তানি সেই মিছিলের মাঝখানে পাকিস্তানের পতাকা উঁচিয়ে ধরে,
তার কী অবস্থা হবে? অথচ, নিজ দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তারপরও
কোনো সুস্থ মানুষ এমন কাজ করবে না। যদি এই কাজ করার জন্য তাকে অনেক অর্থসম্পদের
লোভও দেখানো হয়, তারপরও করবে না। আর যদি এমন হয় যে—এর বদলে সে অর্থসম্পদ পেতেও
পারে, নাও পেতে পারে সেক্ষেত্রে তো কেউ এমন কাজ করার কথা মনেও আনবে না। আবার ধরুন,
ভারত অন্যায় করছে। ভারতের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ (সংস্কার) করার জন্য তাকে পতাকা উচিয়ে ধরতে হবে। করবে কেউ? পাগল ছাড়া কেউ বোধহয়
করবে না। তাহলে ভাবুন, মূর্তিপূজার আস্তানা তৎকালীন আরবে—যেখানে
মূর্তি ছিলো আবেগের উৎস্য—মুহাম্মাদের (ﷺ) সেখানে সরাসরি মূর্তিপূজার
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া উদাহরণে বলা ঘটনাটির মতই আত্মঘাতি না? অর্থসম্পদের জন্যও
কি তিনি এই কাজ করতে পারেন? এক্ষেত্রে তো অর্থসম্পদ বা দুনিয়াবি অর্জন তিনি আদৌ
পাবেন কী-না তার কোনো নিশ্চয়তাও ছিলো না। অনিশ্চিত অর্জনকে সামনে রেখে তিনি জীবন
বিপন্ন করবেন? কিংবা কেবল সমাজ-সংস্কারের জন্য? আপনার যুক্তি কী বলে পাঠক? তারপর
মুহাম্মাদের (ﷺ) জীবনের বাকি ঘটনাগুলো স্মরণ করুন। মক্কায় একাধিকবার
তাঁকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো শ্বাসরোধ করে। (২৭) কখনো বড় পাথর মেরে। (২৮) তাঁকে
এবং তাঁর পরিবারকে তিন বছরের জন্য বয়কট করে ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
(২৯) তায়েফে দাওয়াত দিতে গেলে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা
হয়েছে। (৩০) হিজরতের দিন ১১ জন মিলে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে হত্যার
পূর্ণ ছক সাজানো হয়েছে। (৩১) হিজরতের দিন তাঁকে জীবিত কিংবা মৃত
ধরে আনার জন্য একশো উট পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। (৩২) উহুদের
দিন তাঁর দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছে, চোখে লোহার শলা ঢুকে গিয়েছিলো। এই এতকিছু, মিথ্যার
জন্য? দুনিয়াবি অর্জন তো তাঁর ছিলোই না কিছু। তাহলে অকারণ তিনি মিথ্যা বলে গেছেন? মিথ্যা
বলে এত যন্ত্রণা সহ্য করেছেন? মৃত্যুভয় নিয়ে প্রতিমূহুর্ত বেঁচেছিলেন, কীসের
প্রয়োজনে? পাঠক, নির্মোহ হয়ে চিন্তা করুন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখুন। আপনার কী মনে
হয় এই মানুষটি মিথ্যা বলেছিলেন? তিনি মিথ্যা বলেননি, এটা মেনে নিলেই তাঁর নবুয়ত
সত্য হবে বিষয়টি এমন না। কিন্তু তাঁর জীবনকে নির্মোহভাবে দেখলে, গবেষণা করলে, কোনো
সচেতন মানুষেরই এটা বিশ্বাস হবে না যে, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। এমনকি অনেক অমুসলিম
লেখক, গবেষক, প্রাচ্যবিদও এটা মানতে চান না যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) মিথ্যা বলেছেন। স্কটিশ
ঐতিহাসিক এবং ওরিয়েন্টালিস্ট উইলিয়াম মন্টোগমেরি ওয়াট তার বই Muhammad:
Prophet and Statesman-এ বলেছেন,
“Only a profound belief in himself and his mission explains Muhammads
readiness to endure hardship and persecution during the Meccan period when from
a secular point of view there was no prospect of success.” (৩৩)
একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। হুনাইন যুদ্ধের ঘটনা। বিশাল মুসলিম
সৈন্যবাহিনী ছিলো সেদিন। কিন্তু কাফিরদের অতর্কিত আক্রমণে মুসলিমরা বিক্ষিপ্ত ও
দিশেহারা হয়ে পড়ে। ফলে, তারা পিছু হঠতে থাকে ও পালাতে থাকে। সামনে দুর্ধর্ষ
শত্রুবাহিনী। হিংস্রতার সাথে তারা এগিয়ে আসছে। এদিকে মুসলিম বাহিনী পালাচ্ছে।
মুহাম্মাদের (ﷺ) সাথে আছেন
অল্প ক’জন মানুষ। একজন ভণ্ড নবী এইসময় কী করতেন? নিশ্চয়ই পালিয়ে যেতেন, পিছু
হঠতেন। যুক্তিও প্রস্তুত ছিলো, আমার সৈন্যরা পালিয়েছে, আমি একা থেকে কী করবো?
কিন্তু না! তিনি কী করলেন জানেন? তিনি তাঁর খচ্চরটাকে ছোটাতে লাগলেন। তাঁর মুখ
থেকে একটি কথাই উচ্চারিত হতে লাগলো...
“আনা নাবিয়্যু...লা কাজিব।”
অর্থঃ “আমি নবী...আমি মিথ্যাবাদী নই।”
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
রেফারেন্সঃ
১। আর রাহীকূল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ-১৬২।
২। সূরা আল-আন’আম:
৩৩
৩। আর রাহীকূল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ-(৪০৮-৪১১)।
৪। আর রাহীকূল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স,
পৃ-১০৭। সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ৭০২ ও ৭৪৩ পৃঃ। সহীহ
মুসলিম, ১ম খণ্ড-১১৪ পৃঃ।
৫। কুরআন ও হাদীসের
মু’যিজা নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে এবং ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা
হবে।
৬। সহীহ বুখারী-৫৪২১।
৭। সহীহ বুখারী-৫৪২৩।
৮। সহীহ বুখারী-৬৪৫৯।
৯। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ২০।
১০। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ২২।
১১। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ২৪।
১২। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ২৫।
১৩। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ২৭।
১৪। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ৩১।
১৫। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ৩৯।
১৬। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ৬৯।
১৭। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ৭২।
১৮। রাসূলের চোখে দুনিয়া, মাকতাবাতুল বায়ান, পৃঃ ৮৪।
১৯। হাদীসসমূহঃ
২০। তাঁর সৌন্দর্য্য নিয়ে ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা
করা হবে।
২১। মুহাম্মাদ (ﷺ) কেন এতগুলো বিয়ে করেছিলেন এই
ব্যাপারে বিস্তারিত পড়ুন এখানে- https://cutt.ly/lbkTpuj
২২। আর রাহিকূল
মাখতুম,
তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ৯০।
২৩। আর রাহিকূল
মাখতুম,
তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১৪৪।
২৪। সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব,
পৃঃ ১৬৫।
২৫। সূরা কাফিরুনঃ ১-২।
২৬। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১৪৭-১৪৮।
২৭। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১৩৫-১৩৬।
২৮। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১২৬।
২৯। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১৫১।
৩০। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১৭০।
৩১। আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ২০৬-২০৭।
৩২। সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, ৫৫৪ পৃঃ।
৩৩। William Montgomery Watt, Muhammad: Prophet and
Statesman, page-232.