#বিয়েনামা (সম্পূর্ণ)
Written
By: Asif Mahmud
(১)
-কাল সকালে রেডি থাকিস, মেয়ে দেখতে যেতে হবে।
-কাল সকালে রেডি থাকিস, মেয়ে দেখতে যেতে হবে।
মা এসে আমার রূমে রিমাইন্ডার দিচ্ছেন। এ নিয়ে চারবার হয়ে গেছে। মোবাইলে এলার্ম
দিয়ে রাখলে স্টপ না করে স্নুজ বাটনে ক্লিক করলে যেমন একটু পরপর আবার বেজে উঠে, মা-ও ঠিক তেমন আচরণ করছেন।
-হ্যাঁ ঠিক আছে। আপনি যান, আমি রেডি থাকব ইনশাআল্লাহ।
-এত রাত হয়ে গেল, এখনো ঘুমাইলি না, সকালে উঠে তো ঢুলবি ঘুমে।
-এত রাত হয়ে গেল, এখনো ঘুমাইলি না, সকালে উঠে তো ঢুলবি ঘুমে।
মায়েদের এই এক ডায়লগ, এ জীবনে কতবার যে শুনেছি হিসেব নেই। অবশ্য আমি বাবা থেকেও বহুবার এই
কথাটিই শুনেছি। বাবার ধারণা আমি যেহেতু রাতে দেরিতে ঘুমাই, সেহেতু
আমি ভার্সিটি গিয়ে ক্লাসে ঘুমে টলতে থাকি, কিংবা ঘুমিয়েই
পড়ি। বাবার ধারণা অবশ্য আংশিক সত্য। আমি অনেকদিন ই চেয়ারম্যান স্যারের
সেমিকন্ডাকটর ক্লাসে ঢুলু ঢুলু ভাব নিয়ে ক্লাস করেছি। অনেকদিন ক্লাস মিস ও করেছি।
তাই বড়দের কথা যে একেবারে ফেলনা নয় তাও কিন্তু ঠিক, কিন্তু
তবুও যখন বলে তখন রাগ লাগে। সত্য কথা তেতো কিনা।
-আরে আমি উঠতে পারব আপনি গিয়ে ঘুমান।
-আমি তোর মশারি টাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, কাঁথা আরেকটা লাগলে বলিস, ঠাণ্ডা আছে এখানে অনেক। আর কয়েল দিব?
মশারি দেয়ার পরও কয়েলের প্রয়োজনীয়তা টা কি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
-আপনি এক কাজ করেন, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়েন। কিছু করা লাগবে না এখন আর। আমি শুয়ে যাব।
মায়ের মুখ দেখে মনে হল আমি মশারি ভালমত বিছানার চারপাশে খুঁচে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে উনাকে গুড নাইট বলা পর্যন্ত উনি যাবেন না। অগত্যা বসা থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
-গুড নাইট বলতে হবে?
শুনে মা হাসতে হাসতে চলে গেলেন, আর আমি বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিতে গিয়ে দেখি ফোন নেই। মায়ের কারসাজি বুঝতে আর বাকি রইল না। মা ভালমতই জানে আমি ফোন পাশে থাকলে সহজে ঘুমুব না, তাই আগে ভাগেই ফোন সরিয়ে ফেলেছে। মায়ের উপর রাগের পাশাপাশি একটা স্নেহমিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
-আরে আমি উঠতে পারব আপনি গিয়ে ঘুমান।
-আমি তোর মশারি টাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, কাঁথা আরেকটা লাগলে বলিস, ঠাণ্ডা আছে এখানে অনেক। আর কয়েল দিব?
মশারি দেয়ার পরও কয়েলের প্রয়োজনীয়তা টা কি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
-আপনি এক কাজ করেন, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়েন। কিছু করা লাগবে না এখন আর। আমি শুয়ে যাব।
মায়ের মুখ দেখে মনে হল আমি মশারি ভালমত বিছানার চারপাশে খুঁচে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে উনাকে গুড নাইট বলা পর্যন্ত উনি যাবেন না। অগত্যা বসা থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
-গুড নাইট বলতে হবে?
শুনে মা হাসতে হাসতে চলে গেলেন, আর আমি বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিতে গিয়ে দেখি ফোন নেই। মায়ের কারসাজি বুঝতে আর বাকি রইল না। মা ভালমতই জানে আমি ফোন পাশে থাকলে সহজে ঘুমুব না, তাই আগে ভাগেই ফোন সরিয়ে ফেলেছে। মায়ের উপর রাগের পাশাপাশি একটা স্নেহমিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
(২)
সকালে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে গেল।
-কয়টা বাজছে তোর কোন খবর আছে? মানুষ কেমনে দশটা পর্যন্ত ঘুমায়! দুনিয়ার মানুষ ঘুম থেকে উঠে অর্ধেক কাজকর্ম শেষ করে ফেলেছে।
সকালে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে গেল।
-কয়টা বাজছে তোর কোন খবর আছে? মানুষ কেমনে দশটা পর্যন্ত ঘুমায়! দুনিয়ার মানুষ ঘুম থেকে উঠে অর্ধেক কাজকর্ম শেষ করে ফেলেছে।
মায়ের কথা শুনে ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। নিজেকেই নিজে বিশ্বাস
হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে পাঁচ-ছ মিনিট আগে ফজর পড়ে শুয়েছি। এর মধ্যে দশটা বেজে গেছে!
চোখ ডলতে ডলতে ডাইনিং ক্রস করে বেসিনের দিকে যাচ্ছিলাম, তখনি চোখ পড়ল ঘড়িটায়। আটটা বেজে তিন মিনিট।
মা জাতির উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেল। হায়রে মা! ইচ্ছে করছিল ডাইনিং এই শুয়ে পড়ি,
এত স্বাধের ঘুম আমার! যাহোক, বেসিনে গিয়ে
ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলাম। নাস্তার টেবিলে বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে বসা। বোঝাই
যাচ্ছে আমাকে বেশ কিছু নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবগত করা হবে। আমি ও বেশ গম্ভীর হয়ে
বসে আছি। বাবা গলা খাঁকারি দিলেন। এবার তাঁর স্পিচ শুরু হবে।
-আমরা যাচ্ছি ৬-৭ জন, সেহেতু আমরা বোধহয় একটা গাড়ি নিলে ভাল হয়।
-কি গাড়ি?
-একটা ট্যাক্সি হইলে ভাল হয়।
-ট্যাক্সি কই পাবেন, এখন তো সব সিএনজি।
বাবা আমার দিকে গুলি করে ছাই করে দেয়ার লুক দিলেন, আমি চুপসে গেলাম।
-তোর জামা-কাপড় রেডি আছে?
-আমি শার্ট পড়ে যাবো নাকি পাঞ্জাবি?
-তোর এখনো সেটাও ঠিক নেই? একটা অকেশন, অথচ কোন প্রস্তুতি নাই?
অথচ আমি বাবাকে প্রশ্ন করেছি, আমি শার্ট পড়ব নাকি পাঞ্জাবি, তিনি উত্তরে আমাকে এক দফা শাসিয়ে দিলেন। এটা বাবাদের স্বভাবগত আচরণ। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে লাগলাম। বাবা আবার শুরু করলেন।
-মেয়ের তো কেউ মুখ দেখতে পারল না, শেলীরেও পাঠালাম অন্যভাবে একটু চেহার টেহারা দেখা যায় কিনা, কিন্তু সেটাও হল না। একবার কোনভাবে চেহারা দেখতে পারলে আগানো টা ভাল ছিল। এখন হুট করে দেখতে যাওয়া মানে ওয়ান ফুট ফরোয়ার্ড হয়ে যাওয়া।
বলেই বাবা আমার দিকে তাকালেন। বোধহয় আমার থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করছেন।
-চেহারা দেখে কি হবে? আদার সাইড তো ঠিক আছে। মেয়ে পর্দা-টর্দা করে, পড়াশুনাও আছে, ফ্যামিলিও ভাল।
বাবা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।
-চেহারা দিয়ে কি হবে মানে? চেহারাই তো আসল। ফেইসের সাথে অনেক কিছু রিলেটেড। আমার প্রথম ছেলের বিয়ে, মেয়ে সুন্দর কি অসুন্দর দেখব না?
বাবা এবার কিছুটা উত্তেজিত। আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ খেতে লাগলাম। বাবা এবার নিজেকেই নিজে শান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
-ঠিক আছে, যে বিয়ে করবে, তার সমস্যা না থাকলে আমার আর কি বলার আছে?
-বাবা। বিয়ে করছিনা এখনো। আজ কেবল দেখতে যাচ্ছি। আপনাদের পছন্দ ছাড়া বিয়ে করব বলে তো বলিনি।
বাবা বোধহয় কিছুটা কনভিন্সড হলেন এ কথায়। খাওয়ার পর গোসল সেরে রুমে আসার পর মা কোত্থেকে একটা শেভিং মেশিন নিয়ে আসলেন।
-আমরা যাচ্ছি ৬-৭ জন, সেহেতু আমরা বোধহয় একটা গাড়ি নিলে ভাল হয়।
-কি গাড়ি?
-একটা ট্যাক্সি হইলে ভাল হয়।
-ট্যাক্সি কই পাবেন, এখন তো সব সিএনজি।
বাবা আমার দিকে গুলি করে ছাই করে দেয়ার লুক দিলেন, আমি চুপসে গেলাম।
-তোর জামা-কাপড় রেডি আছে?
-আমি শার্ট পড়ে যাবো নাকি পাঞ্জাবি?
-তোর এখনো সেটাও ঠিক নেই? একটা অকেশন, অথচ কোন প্রস্তুতি নাই?
অথচ আমি বাবাকে প্রশ্ন করেছি, আমি শার্ট পড়ব নাকি পাঞ্জাবি, তিনি উত্তরে আমাকে এক দফা শাসিয়ে দিলেন। এটা বাবাদের স্বভাবগত আচরণ। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে লাগলাম। বাবা আবার শুরু করলেন।
-মেয়ের তো কেউ মুখ দেখতে পারল না, শেলীরেও পাঠালাম অন্যভাবে একটু চেহার টেহারা দেখা যায় কিনা, কিন্তু সেটাও হল না। একবার কোনভাবে চেহারা দেখতে পারলে আগানো টা ভাল ছিল। এখন হুট করে দেখতে যাওয়া মানে ওয়ান ফুট ফরোয়ার্ড হয়ে যাওয়া।
বলেই বাবা আমার দিকে তাকালেন। বোধহয় আমার থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করছেন।
-চেহারা দেখে কি হবে? আদার সাইড তো ঠিক আছে। মেয়ে পর্দা-টর্দা করে, পড়াশুনাও আছে, ফ্যামিলিও ভাল।
বাবা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।
-চেহারা দিয়ে কি হবে মানে? চেহারাই তো আসল। ফেইসের সাথে অনেক কিছু রিলেটেড। আমার প্রথম ছেলের বিয়ে, মেয়ে সুন্দর কি অসুন্দর দেখব না?
বাবা এবার কিছুটা উত্তেজিত। আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ খেতে লাগলাম। বাবা এবার নিজেকেই নিজে শান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
-ঠিক আছে, যে বিয়ে করবে, তার সমস্যা না থাকলে আমার আর কি বলার আছে?
-বাবা। বিয়ে করছিনা এখনো। আজ কেবল দেখতে যাচ্ছি। আপনাদের পছন্দ ছাড়া বিয়ে করব বলে তো বলিনি।
বাবা বোধহয় কিছুটা কনভিন্সড হলেন এ কথায়। খাওয়ার পর গোসল সেরে রুমে আসার পর মা কোত্থেকে একটা শেভিং মেশিন নিয়ে আসলেন।
-এটা কিসের জন্য?
-দাঁড়ি ছোট কর একটু। এত লম্বা রাখলে কেমন দেখা যায়। জামাইকে জামাইর বাপ মনে করবে বুঝেছিস?
-তাতে কি? আমি তো গিয়ে বলবই ছেলে আমি ই।
-আহারে, তারপরও একটা মানানসই আছে না?
-মা, তোমার এই কাহিনী সেই অনেক আগে থেকে শুনছি। তারা আমার এই দাঁড়ি সমেত আমাকে পছন্দ করলে করবে নয়ত না।
-ঠিক আছে, যা ভাল বুঝিস।
-দাঁড়ি ছোট কর একটু। এত লম্বা রাখলে কেমন দেখা যায়। জামাইকে জামাইর বাপ মনে করবে বুঝেছিস?
-তাতে কি? আমি তো গিয়ে বলবই ছেলে আমি ই।
-আহারে, তারপরও একটা মানানসই আছে না?
-মা, তোমার এই কাহিনী সেই অনেক আগে থেকে শুনছি। তারা আমার এই দাঁড়ি সমেত আমাকে পছন্দ করলে করবে নয়ত না।
-ঠিক আছে, যা ভাল বুঝিস।
মা একটু মুখ গোমরা মত করলেন। আমি আজ পর্যন্ত নিজে নিজের লুক নিয়ে যতটা না
চিন্তিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত আমার মা। ছোটবেলা থেকে আমাকে জিন্সে ভাল ধরবে, শার্ট ইন করলে ভাল লাগবে, হাতে একটা ঘড়ি হলে জম্পেশ হবে এসব থিওরি আমার মায়ের। কিন্তু বরাবরই আমার
পছন্দ তাঁর উলটো। তাই মায়ের এই গোমরা মুখ টা দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে।
-আচ্ছা শোন, মেয়ের সাথে কথা বলে দেখবি বুঝছিস? ওখানে গিয়ে বোবা হয়ে যাইস না।
-জ্বি বলব।
-আর হ্যাঁ, মেয়ের হাঁটাচলা খেয়াল করবি, কোন দোষ-টোষ আছে কিনা। রোগা মেয়ে না গছিয়ে দেয়।
-মা, আমি নিজের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি, গরু কিনতে যাচ্ছি না। কি বলছ এসব?
-তর্ক করিস না, বিয়েতে এসব দেখতে হয়। রোগা মেয়ে বিয়ে করবি নাকি?
-আচ্ছা ধরো, মেয়ের কোন রোগ উপর থেকে যেসব চোখে পড়েনা, এরকম কিছু থাকলে? কিংবা আমার থাকলে? আমারো তো থাকতে পারে, আমিও তো জানিনা। তাহলে এটা গছানো কিভাবে হল। এত কিছু ভাবলে হয়?
মা, কি যেন ভাবলেন অনেকক্ষণ। তারপর চলে গেলেন।
-আচ্ছা শোন, মেয়ের সাথে কথা বলে দেখবি বুঝছিস? ওখানে গিয়ে বোবা হয়ে যাইস না।
-জ্বি বলব।
-আর হ্যাঁ, মেয়ের হাঁটাচলা খেয়াল করবি, কোন দোষ-টোষ আছে কিনা। রোগা মেয়ে না গছিয়ে দেয়।
-মা, আমি নিজের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি, গরু কিনতে যাচ্ছি না। কি বলছ এসব?
-তর্ক করিস না, বিয়েতে এসব দেখতে হয়। রোগা মেয়ে বিয়ে করবি নাকি?
-আচ্ছা ধরো, মেয়ের কোন রোগ উপর থেকে যেসব চোখে পড়েনা, এরকম কিছু থাকলে? কিংবা আমার থাকলে? আমারো তো থাকতে পারে, আমিও তো জানিনা। তাহলে এটা গছানো কিভাবে হল। এত কিছু ভাবলে হয়?
মা, কি যেন ভাবলেন অনেকক্ষণ। তারপর চলে গেলেন।
আমি রেডি হয়ে রুম থেকে বের হওয়ার পর বাবা-মা একযোগে আমার দিকে সূক্ষ্মভাবে
দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। বাবা-মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে তাঁরা অন্য কিছু
বলতে চাইছেন। মা ভেতরের দিকে চলে গেলেন। বাবা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,
-তোর কোন অসুখ-টসুখ আছে নাকি রে?
এবার আমার মেজাজ টা গেল তিরিক্ষ্মি হয়ে। চিৎকার করে মা কে ডাক দিলাম, মা দৌড়ে এলেন।
-আপনারা আসলেই অতিরিক্ত করে ফেলছেন। বিয়ের নিকুচি করি, আমি কাল ই ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
বলেই পাঞ্জাবি খুলে ফেললাম। এরপর রুমে চলে এলাম। মা এসে আমার পিঠে মালিশ করতে লাগলেন।
-চল বাবা, রেডি হয়ে নে। আর পাঞ্জাবি টা খুলছিস ভাল হয়েছে, ডিপ কালারে ভাল দেখাচ্ছে না। লাইট কোন কালার থাকলে সেটা পর।
-তোর কোন অসুখ-টসুখ আছে নাকি রে?
এবার আমার মেজাজ টা গেল তিরিক্ষ্মি হয়ে। চিৎকার করে মা কে ডাক দিলাম, মা দৌড়ে এলেন।
-আপনারা আসলেই অতিরিক্ত করে ফেলছেন। বিয়ের নিকুচি করি, আমি কাল ই ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
বলেই পাঞ্জাবি খুলে ফেললাম। এরপর রুমে চলে এলাম। মা এসে আমার পিঠে মালিশ করতে লাগলেন।
-চল বাবা, রেডি হয়ে নে। আর পাঞ্জাবি টা খুলছিস ভাল হয়েছে, ডিপ কালারে ভাল দেখাচ্ছে না। লাইট কোন কালার থাকলে সেটা পর।
অগত্যা হলুদ আর সবুজের মিশ্রিত একটা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে আমি, বাবা, দুই কাকা আর এক
মামাকে নিয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে আমার হবু শ্বশুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। মা কে
সাথে নিলে ভাল হত। মাকে ছাড়া একটা টিশার্ট কখনো পছন্দ করতে পারলাম না, বউ কি পছন্দ করব! কিন্তু মা কেন জানি যেতে চাইলেন না। সিএনজি আনুমানিক
আমাদের বাজার পর্যন্ত পৌঁছালে আমি বাবাকে বললাম,
-বাবা, একটা কার নিলে ভাল হত না?
-বিয়ে করতে যাচ্ছিস নাকি যে কার নিবি?
-না মানে, একটা পার্সোনালিটির ব্যাপার আছে না। ভাল চাকরিবাকরি করি হিসেবে, একেবারে একটা সিএনজি নিয়ে গেলে কেমন দেখায় বিষয়টা।
বাবা আমার কথায় কিছুটা কনভিন্সড হলেন। বাজারে নেমে একটা কার ভাড়া নিলাম আমরা। কারে বসে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম, যাক একটা পার্সোনালিটি সম্পন্ন এন্ট্রি হবে ঐ বাড়িতে। কিন্তু আমার পাঞ্জাবির কালার নিয়ে আমি মোটেও সন্তুষ্ট ছিলাম না। মনের মধ্যে খুতখুত ভাব হচ্ছিল, “যাহ! বাজে দেখাচ্ছে!”
(৩)
কারে চড়ে মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট সময় লাগল, এর মধ্যেই বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। সবাই মিলে ঝাঁকুনি প্রয়োগ করে বাবাকে উঠাতে হল। এবার গাড়ি থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করতে লাগলাম। সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর জানালা দিয়ে মুখে বের করে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বু, আমি কি এখন বের হব?”
-তো কি আমরা মেয়ে দেখে চলে যাব?
বাবার উত্তরে লজ্জা পেয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। এদিকে ওদিক থেকে ও বাড়ির লোকজন আমাদের রিসিভ করতে এগিয়ে এল। সবাই এসে হাত মিলিয়ে মোবারকবাদ জানাল। এরপর আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। সবাই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। এক হাজার দর্শকের সামনে মাইক হাতে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকার মত ব্যাপার এটা খানিকটা। একেকজন একেকরকম প্রশ্ন করতে লাগল। সবার প্রশ্নের ডাইমেনশন অনেকটা একই রকম ছিল, আর সবাইকে দেখতে একইরকম বয়স্ক দেখাচ্ছিল, ফলে আমি মেয়ের বাবা নির্ধারণ করতে অসমর্থ হলাম। এটা আমার আজীবনের ব্যর্থতা। একবার বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে বন্ধুর ভায়রা কে তার শ্বশুর ভেবে বেশ খাতিরযত্ন করে শেষমেশ বন্ধুকে এসে বললাম, “তোর শ্বশুরের বেশ খাতিরযত্ন করলাম আজ”
“মানে? আমার তো শ্বশুর বেঁচেই নেই”
সেই দিনের পর থেকে আমি আর কখনো কারো শ্বশুর কে খাতির যত্ন করতে যাইনি।
-বাবা, একটা কার নিলে ভাল হত না?
-বিয়ে করতে যাচ্ছিস নাকি যে কার নিবি?
-না মানে, একটা পার্সোনালিটির ব্যাপার আছে না। ভাল চাকরিবাকরি করি হিসেবে, একেবারে একটা সিএনজি নিয়ে গেলে কেমন দেখায় বিষয়টা।
বাবা আমার কথায় কিছুটা কনভিন্সড হলেন। বাজারে নেমে একটা কার ভাড়া নিলাম আমরা। কারে বসে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম, যাক একটা পার্সোনালিটি সম্পন্ন এন্ট্রি হবে ঐ বাড়িতে। কিন্তু আমার পাঞ্জাবির কালার নিয়ে আমি মোটেও সন্তুষ্ট ছিলাম না। মনের মধ্যে খুতখুত ভাব হচ্ছিল, “যাহ! বাজে দেখাচ্ছে!”
(৩)
কারে চড়ে মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট সময় লাগল, এর মধ্যেই বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। সবাই মিলে ঝাঁকুনি প্রয়োগ করে বাবাকে উঠাতে হল। এবার গাড়ি থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করতে লাগলাম। সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর জানালা দিয়ে মুখে বের করে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বু, আমি কি এখন বের হব?”
-তো কি আমরা মেয়ে দেখে চলে যাব?
বাবার উত্তরে লজ্জা পেয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। এদিকে ওদিক থেকে ও বাড়ির লোকজন আমাদের রিসিভ করতে এগিয়ে এল। সবাই এসে হাত মিলিয়ে মোবারকবাদ জানাল। এরপর আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। সবাই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। এক হাজার দর্শকের সামনে মাইক হাতে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকার মত ব্যাপার এটা খানিকটা। একেকজন একেকরকম প্রশ্ন করতে লাগল। সবার প্রশ্নের ডাইমেনশন অনেকটা একই রকম ছিল, আর সবাইকে দেখতে একইরকম বয়স্ক দেখাচ্ছিল, ফলে আমি মেয়ের বাবা নির্ধারণ করতে অসমর্থ হলাম। এটা আমার আজীবনের ব্যর্থতা। একবার বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে বন্ধুর ভায়রা কে তার শ্বশুর ভেবে বেশ খাতিরযত্ন করে শেষমেশ বন্ধুকে এসে বললাম, “তোর শ্বশুরের বেশ খাতিরযত্ন করলাম আজ”
“মানে? আমার তো শ্বশুর বেঁচেই নেই”
সেই দিনের পর থেকে আমি আর কখনো কারো শ্বশুর কে খাতির যত্ন করতে যাইনি।
-বাবা, তো তোমার পরবর্তী প্ল্যান কি? পড়ালেখা বা চাকরির ব্যাপারে?
অবশেষে আমি মেয়ের বাবা খুঁজে পেতে সক্ষম হলাম। তাঁর এই প্রশ্নে আমি সহজ সরল উত্তর দিলাম।
-এর চেয়ে ভাল স্যালারির কোন চাকরি খোঁজার ইচ্ছে আছে আপাতত।
লোকটা পড়ালেখার ব্যাপারে কেন জানতে চাইল বুঝতে পারলাম না। এমএসসি পাশ করেছি, আর কত পড়ব, চাকরি করছি, বিয়ে করতে এসেছ্ বিয়ে শাদি করে সংসার এই তো জীবন। আর কি! তবে তিনি আমার উত্তরে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হতে পারলেন বলে মনে হয়না। তার চেয়ে বোধহয় আমি পিএইচডি করতে আমেরিকা যাব বললে তিনি খুশী হতেন। বলি, তাহলে আপনার মেয়েকে খাওয়াবে কে? আর অত টাকা তো আমার বাবার নেই যে আবার পিএইচডি এর জন্য আমেরিকা পাঠাবে।
অবশেষে আমি মেয়ের বাবা খুঁজে পেতে সক্ষম হলাম। তাঁর এই প্রশ্নে আমি সহজ সরল উত্তর দিলাম।
-এর চেয়ে ভাল স্যালারির কোন চাকরি খোঁজার ইচ্ছে আছে আপাতত।
লোকটা পড়ালেখার ব্যাপারে কেন জানতে চাইল বুঝতে পারলাম না। এমএসসি পাশ করেছি, আর কত পড়ব, চাকরি করছি, বিয়ে করতে এসেছ্ বিয়ে শাদি করে সংসার এই তো জীবন। আর কি! তবে তিনি আমার উত্তরে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হতে পারলেন বলে মনে হয়না। তার চেয়ে বোধহয় আমি পিএইচডি করতে আমেরিকা যাব বললে তিনি খুশী হতেন। বলি, তাহলে আপনার মেয়েকে খাওয়াবে কে? আর অত টাকা তো আমার বাবার নেই যে আবার পিএইচডি এর জন্য আমেরিকা পাঠাবে।
মানুষ চতুর্দিক থেকে শুধু প্রশ্ন করছে, মনে হচ্ছে কোন সংবাদ সম্মেলনে আছি। উপর্যুপরি প্রশ্নের পাথরে
বিক্ষত হয়ে যাচ্ছি। এদিকে নাস্তার ট্রে সামনে পড়ে আছে, এতক্ষণে
বোধহয় সব নাস্তা ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ হাত ও বাড়াচ্ছে না,
আর আমি তো পাত্র, তাই যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন
করছি। আর এদিকে মেয়েকে তো বের ই করছে না। আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এমন হবে, আসলাম, দেখলাম, চলে গেলাম।
কিন্তু না, এসেছি দুঘণ্টা হয়ে গেছে, এখনো
তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি যে তারা মেয়েকে বাইরে আনবে কিনা। মেয়ের বাবা
বারবার ভেতরে যাচ্ছেন আবার বাইরে আসছেন। মেয়ের দুই ভাই আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে একটা হুংকার
দেখতে পাচ্ছি, “তুই মানুষ সলিড তো? নাইলে বোন বিয়া দিমু না” আমিও
নিজেকে খুবই নিষ্পাপ ভাবে উপস্থাপন করতে চাইলাম। এতে কেউ সন্তুষ্ট হল কিনা জানিনা
তবে আমি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হচ্ছিলাম নিজের পারফরম্যান্সে।
কিছুক্ষণ পর লম্বা ঘোমটা সমেত মেয়েকে এনে আমার সামনের সোফায় বসানো হল। আমার
মাথা নিচু হয়ে গেল। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে এপাশ থেকে ওপাশে চলে যায়, আমি লজ্জায় তার চেহারার দিকে তাকাতে
পারিনা। সে আমার দিকে তাকিয়েছে কিনা তাও বুঝতে পারছিনা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে
যাওয়ার পর, সবাই বলল, “ওর সাথে কথা বল,
কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পার”। এবার আমি বেশ বেকায়দায় পড়ে
গেলাম, লজ্জায় তো তাকাতেই পারছিনা, এর
উপর প্রশ্ন করব! আমি মাথা না উঠিয়েই বললাম, “না, আমি কি জিজ্ঞেস করব। মেয়েও চুপ করে আছে” বাবা, এগিয়ে
গিয়ে মেয়ের হাতে একটা প্যাকেট গুজে দিলেন, সোনার চেইন ছিল
বোধহয়। এর মধ্যেই মেয়েকে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য বলা হল। আমার মাথায় বাজ পড়ল! আরে,
আমি তো দেখলাম ই না। সাথে সাথে মাথা উঠিয়ে দেখি মেয়ে ততক্ষণে উঠে
ওপাশ ফিরে গেছে। দেখতে দেখতে সে অন্দরমহলে চলে গেল। আমার মনের মধ্যে তখন
“অপরিচিতা” গল্প পাঠ শুরু হয়ে গেছে! আমি হাসফাঁস করতে লাগলাম। বাবার চেহারা কিছুটা
উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বোধহয় মেয়ে তাঁর পছন্দ হয়েছে। সবাই এর
মধ্যে বেশ মিশে গেছে একে অপরের সাথে। আর এদিকে আমার ভেতরে কম্পন শুরু হয়ে গেছে।
নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। কি করলাম? এবার এই সমস্যার
সমাধান কি! কথায় বলে নিয়ত গুণে বরকত। আমি ই বলেছিলাম চেহারা দেখে কি হবে? তাই বলে চেহারা টাই দেখা হল না। নিজেকে বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ দুষলাম।
এরপর আমরা সবাই উঠলাম, যাওয়ার বেলায় হবু শ্বশুর আমাকে জড়িয়ে
ধরলেন। আমি দোয়া চেয়ে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমার মাথা ততক্ষণে ঘুরতে শুরু করে
দিয়েছে। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পাঁচ মিনিটের সময় আমি বাবাকে বললাম, “বাবা, আমি মেয়ের চেহারা টা দেখতে পারিনি” এই কথার
সাথে সাথে ড্রাইভার হার্ড ব্রেক কষল। বাবা চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম বড় করে ধপ করে
সিটে শুয়ে পড়লেন।
(৪)
মেয়ের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আমার উপর
ঝড় যাচ্ছে প্রচণ্ড। সবাই আমার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। বাবার মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর ড্রাগনের মত আগুন বের হচ্ছে।
-আরে, ওখানে যখন
ছিলাম, তখন বললেও তো হত। মেয়েকে কি আবার ডেকে
আনা সম্ভব ছিল না? গাধা কোথাকার!
-আমি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। এসব বিষয়ে আমার কি কোন ধারণা আছে নাকি। প্রথম বিয়ে আমার। আগে করেছি নাকি কখনো বিয়ে?
বাবা এবার আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালেন।
-প্রথম বিয়ে মানে? তোর কি আরো বিয়ে করার মতলব আছে নাকি রে?
মেজাজ টা চড়েই যাচ্ছিল, তখনি মা আসলেন।
-তো এখন কি করবেন বলে চিন্তা করছেন?
মা বাবার দিকে নরম সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। বাবা শান্ত হয়ে খাটে বসলেন।
-এখন আর কি করা যাবে? মেয়েকে চেইন দিয়ে এসেছি। চেইন দেয়া মানে তো হ্যাঁ এর ইঙ্গিত। আমার পছন্দ হয়েছে মেয়ে। তাই হুট করেই চেইন টা দিয়ে দিলাম। এই অপদার্থ যে না দেখে বসে আছে আমি কি জানতাম?
-আপনার পছন্দ হলেই হয়েছে। আমি আর কি করব দেখে?
-আমি আর কি করব দেখে!
বাবা আমার কথার অনুকরণ করে ব্যঙ্গ করলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন,
-এখন আর আগের যুগ আছে নাকি যে বাবার
পছন্দে ছেলে বিয়ে করে ফেলবে? তুই যেখানে আজীবন সংসার করবি,
সেখানে তুই দেখাটা জরুরি না?
-আপনি দেখেছেন, আপনার পছন্দ হয়েছে যেহেতু, আমারো পছন্দ হবে।
আমি কিছুটা আবেগী সুরে বললাম। ভাবলাম, বাবা এতে কিছুটা শান্ত হবেন আর এমন
ছেলের বাবা হতে পেরে গর্ববোধ করবেন। কিন্তু তা না হয়ে হল উলটো।
-স্টার জলসার সিরিয়ালের ডায়লগ দিচ্ছিস?
সিনেমা চলছে এখানে? বিয়ে মানে বুঝিস? সারাজীবনের ব্যাপার। পরে সারাজীবন আমাকে গালি দিবি।
-তো এখন আর কি করার আছে?
মা করুণ সুরে বললেন। আমার সাইড নিচ্ছেন কিনা বুঝতে পারছিনা, তবে
মা যতবার ই কথা বলছেন, বাবা কিছুটা শান্ত হচ্ছেন। বাবা এবার বালিশ টেনে নিয়ে হেলান দিয়ে শুলেন।
-ব্যাপারী কে দায়িত্ব দিয়েছি মেয়ের
একটা ছবির ব্যবস্থা করার জন্য। দেখি পারে কিনা।
ব্যাপারী সাহেব আমাদের বিয়ের সার্বিক
ঘটকালীর দায়িত্বে আছেন। তার মাধ্যমেই বিয়ের কথাবার্তা এগুচ্ছে। আমি বললাম,
-কিন্তু ছবি দেখে কি বুঝবো?
এবার বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
-এতক্ষণ তো না দেখেই বিয়ে করছিলি,
এখন ছবি দেখলেও হচ্ছেনা? শোন, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। ছবি দেয় কিনা আগে সেটা
দেখ।
আমি আর কিছু বললাম না। বাবা শুয়ে চোখ বুজলেন। মা ও রান্না ঘরে চলে গেলেন। আমি গিয়ে ফোন নিয়ে বসলাম। একটা স্ট্যাটাস না দিলে চলছেই না।
(৫)
আবারো আমার নিয়্যাত তার গুণ দেখালো। মেয়ে ছবি দিতে না করে দিয়েছে। ব্যাপারী সাহেব খবর এনেছেন। তাদের বক্তব্য মেয়ে দেখার পর আবার ছবি কেন। যদিও পুরো ঘটনা তাদের
অবগত করা হয়নি। এমনকি ব্যাপারী সাহেব ও জানেন না। বাবার ধারণা বিষয়টা জানাজানি হলে মানইজ্জতের প্রশ্ন। কিন্তু অলরেডি এই বিষয়টা
আমি আমার ফেইসবুকের তেরশ জন বন্ধুকে জানিয়ে দিয়েছি। এই স্ট্যাটাসে হাহা
রিয়েকশন পড়েছে একশ তেইশ টি। কিন্তু এদিকে বাবা-মায়ের রাতের ঘুম হারাম। এখন কি করে কি হবে? বাবার ভাষ্যমতে আমরা অলরেডি ওয়ান ফুট ফরোয়ার্ড হয়ে গেছি। এখন হুট করে পেছনে যেতে হলে কোন একটা বড়সড় কারণ অবশ্যই দেখাতে হবে। মেয়েপক্ষ আমাদের উত্তরের অপেক্ষায় আছে, আমাদের
দিক থেকে গ্রিন সিগনাল পাওয়া গেলে বিষয়টা এগুবে। বাবা-মা দিনরাত এটা নিয়ে কথা বলছে আর আমি শুয়ে শুয়ে ফেইসবুকে রিয়েক্ট
গুনছি। রাতের বেলা খাবার টেবিলে আমার আর বাবার ফেস টাইম। এ ফেস টাইমে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। এখানে বসেই প্রস্তাব
উত্থাপন করেছিলাম আমি মেডিকেল না পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব, যেটা প্রায় কয়েকবার দফায় দফায় আলোচনা করে এবং বেশ কয়েকটি চুক্তি
মেনে নেয়ার পর অনুমোদিত হয়। অবশ্য এখানে মা ধনাত্মক প্রভাবক
হিসেবে ক্রিয়া করেছেন প্রতিবারই। মায়ের নরম সুরের একটি বাক্য, “দেন না, সে যেদিকে যেতে চায়”
এ টেবিলে বসেই বোনের বিয়ের আলোচনা, ছোটভাইয়ের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিজেদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সকল বিষয়েই আলোচনা পর্যালোচনা সম্পন্ন হয়। আজও টেবিলে আলোচনা বসেছে। বাবা সভাপতির ভূমিকা পালন করছেন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শুরু করলেন,
-তো এখন কি সিদ্ধান্ত?
বলেই চুপ করে গেলেন। বাবা সরাসরি কিছু বলেন না। তবে প্রশ্নটি আমাকেই করা এবং যথোচিত
উত্তর না পেয়ে আমি চুপ করে রইলাম। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার
বললেন,
-এখন যদি আমরা ফরোয়ার্ড হই,
তাহলে আর পেছানোর সুযোগ নাই। তাই সিদ্ধান্ত টা হয়ে
যাওয়া জরুরী। তোর মতামত কি?
-আমি কি বলব? আপনারা যেটা ভাল মনে করেন।
-এ ধরণের কথাবার্তা বললে তো হবেনা। সোজাসাপ্টা কোন উত্তর নাই?
-আচ্ছা সোজাসাপ্টা ই বলি। মেয়ে দেখা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নাই। আপনি হ্যাঁ বলে দেন।
এ কথা শুনে বাবা খুশী হলেন কি বেজার হলেন
বুঝতে পারলাম না। তবে আর কিছু বললেন না, চুপচাপ খাওয়া শেষ করলেন।
(৬)
সকাল টা প্রতিদিন মায়ের চেঁচামেচি তে
শুরু হওয়াটা এখন চিরন্তন সত্য হয়ে গেছে। মায়ের চেঁচামেচি বলার কারণ হচ্ছে
মা মূলত চেঁচামেচি ই করে, তিনি এভাবে কর্কশ ভাবে
কোন কথা বলেন, কিংবা কাউকে বলেন বলে মনে হয়না। আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, এই চেঁচামেচি টা ইচ্ছাকৃত। ঘুম থেকে উঠেই আমি নিজেকে কোন এক ভিনগ্রহের প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করলাম। মা আমাকে দেখে কথা বললেন না। বাবা তো সেই কখন থেকে ঝিম মেরে শুয়ে
আছে। মা তেল আর পানি মিশিয়ে বাবার মাথায় ঘষছেন। আমি ইশারায় ছোটভাই কে ডাক দিলাম, “কি
হয়েছে রে বাবার?”
-প্রেশার বাড়ছে।
-কেন? হঠাৎ!
-জানেন না? আপনার কারণে।
‘জানেন না’ কথাটা এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে
বলল, আমার মনে হল আমি সত্যি কোন হিন্দি সিরিয়ালে ঢুকে পড়েছি। আর ‘আপনার কারণে’
কথাটার ভঙ্গি এমন ছিল, আমার আতিফ আসলাম এর ‘তেরে লিয়ে’ গান টা মনে পড়ে গেল। আমি
ব্রাশ করে রুমে বসে রইলাম। কেউ নাস্তা এনে দিল না আজ। রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে
গিয়ে মা কে আবিষ্কার করলাম।
-বস।
-কি হয়েছে মা?
-দুর্ঘটনা ঘটাই দিয়ে বলিস কি হয়েছে?
সবার কথায় এত নাটকীয়তা। শুনে মনে
হচ্ছে কাল রাতে আমি অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে পিশাচ হয়ে গেছি আর কয়েক হাজার মানুষের
রক্ত চুষে নিয়েছি।
-আরে কি হয়েছে বলবেন তো!
-তুই ফেসবুকে কি লিখেছিস?
-সে খবর আপনি কি করে জানেন?
-তোর এ খবর তিন গ্রামের লোক জানে
এখন। বুদ্ধিসুদ্ধি আল্লাহ কবে দিবে তোকে।
-কোন তিন গ্রাম?
-মজা নিচ্ছিস আমার সাথে?
-আরে কি হয়েছে সেটা তো বলেন। আপনারা
কিভাবে জানলেন? আর বাবার কি হয়েছে?
-কুটুমবাড়ি পৌঁছে গেছে তোর এই খবর।
সেখান থেকে ফোন আসছে। তোর বাবার এসব শুনে প্রেশার উঠে গেছে। তুই আগামী কয়েকদিন
ভুলেও তোর বাবার সামনে যাবিনা। আল্লাহ জানে আর কে কে শুনছে এই খবর। তোর
খালা-খালুরা দেখলে কি যে মুসিবত হবে। এমনেও বলছে, ছেলের বুদ্ধিসুদ্ধি হোক- তারপর
বিয়ে দিয়েন।
মা আরো কি কি জানি বলছিল। আমি উঠে
চলে এলাম। বুঝতে পারছি দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত চলছে। আপাতত পালাতে হবে কোথাও।
তড়িঘড়ি করে ফেসবুক থেকে পোস্ট ডিলিট করে দিলাম। রুমের দরজা বন্ধ করে কাঁথা জড়িয়ে
শুয়ে নিজেকে আত্মগোপনে নিয়ে গেছি টাইপ ফিল করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেই ঘুম
ধরে গেল। দরজাইয় প্রচণ্ড আঘাতে ঘুম ভাঙল আমার। মনে হচ্ছে দরজার ওপাশে প্রচুর
মানুষ, অনেকের কথা শোনা যাচ্ছে। আর দরজায় প্রচন্ড করাঘাত চলছে। আমি টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম বাবা তেলে
ডুবানো মাথা সমেত দাঁড়িয়ে আছে, সাথে চাচারা আর মা তো অর্ধেক মূর্ছিত! আমি যেন আকাশ
থেকে পড়লাম। সবাই আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে ছোটভাই দেখলাম হাতুড়ি
নিয়ে দৌড়ে এল। আমাকে দেখে হাতুড়ি হাতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।
-মা! কি হয়েছে? সবাই কেন এভাবে
দাঁড়িয়ে আছে? দরজা ভাঙতে এসেছিল নাকি সবাই?
বাবা এবার রাগে গজগজ করতে চলে গেলেন।
সবাই তো হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মায়ের মূর্ছা ভাব এখনো কাটেনি। আমি মা কে খাটে
বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
-মা, আমি বোকা। কিন্তু এতটাও বোকা না যে ছোটখাট বিষয়ে সুইসাইড করে ফেলব,
রিলেক্স!
মা শান্ত হলেন। কিন্তু বাবা বরাবরই
রাগছিলেন, আর আমার ভয় পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
(৭)
মেয়ের বাড়ি থেকে খবর পাঠানো হয়েছে
মেয়ের সাথে আমার আলাদা ভাবে একটা সাক্ষাতের ব্যাপারে। শুনেই আমি আনন্দে গদগদ হয়ে
গেলাম। কিন্তু বাবা এতে খুশি নন।
-সেয়ানা লোক এরা। মেয়ে আর ছেলের সাক্ষাত
করিয়ে দিচ্ছে। মানে বুঝিস এর? তোর আর রিজেক্ট করার কোন সুযোগ নেই। পছন্দ হলেও বিয়ে
করতে হবে, না হলেও।
-জ্বি আচ্ছা।
-জ্বি মানে? আমি কিছুই বুঝলাম না। এত
বড় বিষয়ে তোর কোন মাথাব্যাথা নেই? মেয়ে পছন্দ না হলে? পরে তালবাহানা করে লাভ হবে?
বাবা যুক্তিযুক্ত কথা বলছেন, কিন্তু
আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার মনের মধ্যে অপরিচিতা পাঠ চলছে। “এই অবকাশের মরুভূমির
মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিল— আকাশে তাহার দৃষ্টি, বাতাসে তাহার নিশ্বাস, তরুমর্মরে
তাহার গোপন কথা। আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে
লাগিল।
সে নিজের চারি দিকের সকলের চেয়ে অধিক—রজনীগন্ধার শুভ্র মঞ্জরীর মতো
সরল বৃন্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে
একেবারে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে"
বাবা
আমার উদাসীন ভাব দেখে বিরক্ত হলেন। বললেন, “তোর যা মন চায়, তা-ই কর”
আমি
ততক্ষণে পা দুটি চেয়ারের মধ্যে গুটিয়ে বসেছি আর কাটা চামচ দিয়ে বিস্কুট গেঁথে
খাওয়ার চেষ্টা করছি। বাবা গভীর ভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি বিস্কুট চায়ে
চুবিয়ে কিছুক্ষণ রাখতেই সেটা ভেঙে পড়ে গেল। সাথে সাথে গরম চায়ে আঙুল ডুবিয়ে বিস্কুটা
টা উদ্ধার করার চেষ্টা করতে গিয়ে হাত পুড়ে ফেললাম। দৌড়ে বেসিনের দিকে যেতে যেতে
শুনলাম বাবার বাণী, “এই ছেলে করবে বিয়ে!”
(৮)
মেয়ের
সাথে সাক্ষাতের দিন চলে এল। আমি আজ বেশ সকাল সকাল উঠে গোসল সেরে আয়নার সামনে
দাঁড়ালাম। আজ অনেকদিন পর কেমন যেন নিজেকে সাজিয়ে ফেলতে মন চাইল। সাজানোর উপকরণ
হিসেবে ছিল ছোটবোনের ‘ফেয়ার এন্ড লাভলির’ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটি ক্রিমের বোতল,
সেই সাথে ‘কিউট’ নামের একটি তেলের বোতল, আর একটি চিরুনি। আমার ব্যবহারযোগ্য আর
বিশেষ কিছু পেলাম না। মনক্ষুণ্ণ হলাম কিছুটা। তবে যা পেলাম তা দিয়েই নিজেকে সাজিয়ে
ফেলার একটা বৃথা চেষ্টা সম্পন্ন করে মায়ের অপছন্দের ডিপ কালার পাঞ্জাবি টাই পরলাম।
রুম থেকে বেরুতেই মায়ের সামনে পড়লাম।
-এটা
কি কালারের পাঞ্জাবি পড়েছিস? ভাল লাগছে না।
এই
আশংকাই করছিলাম।
-কেন
মা? ভালই তো লাগছে।
-তুই
কি বুঝবি? তোর কোন চয়েস আছে?
-তাইলে
আমার চয়েসের জন্য বিয়ে কেন আটকে আছে?
মা আর
কিছু বললেন না। আমি মায়ের মন রক্ষার জন্য পাঞ্জাবি টা খুলে একেবারে টুকটুকে লাল
একটা পাঞ্জাবি পড়ে বেরুলাম। বেরিয়ে বাজার পর্যন্ত আসার পর হঠাৎ মনে পড়ল, দেখা
কোথায় করব সেটা তো জানা হয়নি! তড়িঘড়ি করে মা কে ফোন দিলাম।
-হ্যালো
মা! দেখা কোথায় করব? সে কোথায় আসবে?
-মানে?
তোকে ঐ মেয়ের নাম্বার দিয়েছে না ব্যাপারী সাহেব?
-কই?
দেয়নি তো!
ঐদিকে
বাবার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। “এই ছেলেকে আবার বিয়ে দেবে! দেখ, এমন ছাগল দুনিয়ায় আছে!”
মা
বলল, “আপনি থামেন তো”
-আচ্ছা
শোন, মেয়ের বাবার নাম্বার আছে আমাদের কাছে। দিব?
-মেয়ের
বাবার নাম্বার দিয়ে আমি কি করব? আমি তাকে ফোন দিব নাকি? আপনি বাবারে বলেন উনার
সাথে কথা বলতে, বলে মেয়ের নাম্বার নিয়ে আমাকে পাঠাতে।
মাকে
আর বলতে হল না। ঐপাশ থেকে বাবাই উত্তর দিলেন, “এসব আমি পারব না, তোর বিষয় তুই-ই
বুঝ”
মনে
মনে ভাবলাম, এটা বাবা না রাক্ষস। সারাক্ষণ হুংকার ছাড়া কিছুই জানেনা। অগত্যা মায়ের
থেকে মেয়ের বাবার নাম্বার নিয়ে আমি নিজেই ফোন করলাম।
রিং যাচ্ছে
আর এদিকে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কি বলব, কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা। মনের মধ্যে কথা সাজিয়ে শেষ করার আগেই তিনি ফোন ধরে ফেললেন, ফলে কথা গেল গোল পাকিয়ে। আমতা আমতা করতে করতে ফোন কেটে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর কথা সাজিয়ে আবার ফোন করলাম।
-হ্যালো
আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
-ওয়া
আলাইকুম সালাম। কে?
-আঙ্কেল
আমি আসিফ।
-কোন
আসিফ?
এই
প্রশ্নের উত্তর আমার সত্যিই জানা নেই। আমি কি বলব? আপনার হবু জামাই আসিফ? নাকি ঐযে
আঙ্কেল ঐদিন যে আপনার মেয়েকে দেখতে আসছিলাম, দেখতে পারিনি যে, ঐ আসিফ আরকি! এত সব
ভাবনা ভাবতে ভাবতে কোন উত্তর দিতে পারছিলাম না।
-আরে
কে ভাই? জবাব দিচ্ছ না কেন?
ইচ্ছে
হচ্ছিল বলি, “রিশতে মে তো হাম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যায়, নাম হ্যায় আসিফ” কিন্তু
নিজেকে সংবরণ করলাম এবং নার্ভাস হয়ে বলে ফেললাম। “আমি জামাই বলছি”
এবং
এখানে ভাগ্য আমার সাথে হেরা ফেরি খেলল। হ্যাঁ পাঠক, আমি আবারো নিজেকে বোকাশ্বর
প্রমাণ করতে যাচ্ছি! বোকাশ্বর মানে, বোকাদের ঈশ্বর।
মূহুর্তে
শ্বশুর বাবাজী আমার ‘জামাই’ কথাটি শুনে আমাকে নিজের বড় জামাই ভেবে নিলেন। ভাগ্য
এতটাই খারাপ যে পরে শুনেছি তার বড় জামাইয়ের নাম ও নাকি আসিফ।
-আরে
জামাই! কি খবর?
-জ্বি।
ইয়ে মানে … ওর
সাথে আজ দেখা করার কথা ছিল।
আমি বোধহয়
পৃথিবীর প্রথম বোকা ছেলে যে হবু বউয়ের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। তাই আর কোন সম্বোদন না পেয়ে ‘ও’ বলেই সম্বোদন করলাম। আর তাতেই আমার শ্বশুর বাবাজী, আমাকে তার বড় জামাই হিসেবে সম্পূর্ণ ভাবে ধরে
নিলেন।
-তা বাবা,
সালমা তো আমাকে কিছু বলল না।
অবশেষে
জানলাম মেয়ের নাম সালমা। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আগে কি সালমা ই শুনেছি?
কেমন একটা কনফিউশনে ভুগছিলাম। এটা
যে বিপদের পূর্বাভাস ছিল বুঝিনি তখন।
-কিছু
বলেনি? কিন্তু আমাকে তো বলল দেখা করার কথা।
-আচ্ছা। আমি তাহলে ওকে পাঠাই বরং।
-জ্বি। আমি ফুড গার্ডেনে অপেক্ষা করব। আসসালামু
আলাইকুম।
এটুকু বলেই
আমি ফোন রেখে দিলাম। নিজেকে বীর মনে হচ্ছিল। শ্বশুরের সাথে কথা বলে হবু বউকে বের করে নিয়ে আসছি, আসলেই অনেক বীরত্ব দেখাচ্ছি। ফুড গার্ডেনে আধঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর আমার ফোনে একটা ফোন
আসল, “তুমি কোথায়?”
একটা মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠ! আমার মনে লাড্ডু ফুটল!
বুঝতে পারলাম সালমা হবে। তবে প্রথম আলাপেই ‘তুমি’ বলে ফেলাটা কেমন
বিব্রতকর ঠেকল আমার কাছে। আমি তো ভেবেছিলাম মেয়েটা বেশ কনজারভেটিভ হবে, সবসময় আপনি
করেই বলবে। এখন দেখি উলটো। যাহোক আমি বললাম, “আমি রেস্টুরেন্টের ভেতরেই আছি” তখনি
গেইট দিয়ে বোরকা পরিহিত একটা মেয়ে ঢুকল, মেয়ে না বলে মহিলা বলাই বেটার। এবং সাথে
একটা তিন-চার বছরের বাচ্চা মেয়ে। এবং তার হাতে ফোন, মনে হল এই মহিলাই আমার সাথে
এইমাত্র কথা বলেছে। তখনি আমার মাথার মধ্যে সবকিছু আসতে শুরু করল, উলটাপালটা ঘটিয়ে
দিয়েছি বোধহয় সব! মেয়ের জায়গায় মেয়ের বোন চলে আসেনি তো। আমার যতদূর মনে পড়ে মেয়ের
নাম সালমা শুনিনি। তবে কি আমার কনফিউশন সত্যি হয়ে গেল? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মহিলা
আমার বেঞ্চের সামনে এসে হাজির। চেয়ারে বসে বলল,
“তুমি
কি সত্যিই এতটা বোকা?”
প্রথম
লাইনটিই আমাকে ভড়কে দিল। আমি নিচের দিকে তাকাচ্ছি শুধু, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
“তুমি
বাবাকে ফোন করে কার কথা বলেছো তুমি জানো? তোমার ঐদিনের ঘটনায় তো তোমাকে নিয়ে বেশ
হাসাহাসি হয়ে গেছে। আজকেও তুমি নিজেকে হাসির খোরাক বানালে। আর ওদিকে নীরা রেডি হয়ে
বসে আছে তার হবু জামাই তাকে ফোন করবে, আর এদিকে আমি ছোটাছুটি করে বাচ্চাকাচ্চা
নিয়ে বের হয়ে এলাম”
“নীরা!
এক্সাকলি নীরা!” আমি হাত উঁচিয়ে উতফুল্ল হয়ে একটা চিৎকার দিলাম! “নীরা নাম ছিল
এক্সাকলি। আমি এতক্ষণ মনে করতে পারছিলাম না”
আমার
আচরণে সালমা আপু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার বোনের ভাগ্য যে খুব খারাপ হতে চলেছে
সেটা ভেবে তিনি খুবই নিরাশ হলেন বোধহয়। নাকি সহজ সরল জামাই পেয়ে বোনের ভাগ্য
উজ্জ্বল হবে ভেবে উতফুল্ল হলেন, কোনটাই তাকে দেখে বোঝা গেল না, কারণ তার চেহারা
ঢাকা ছিল। তবে তিনি আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে গেলেন। আমি আগেই অর্ডার করা পেপসির
বোতলে মুখ লাগালাম। মা ফোন করছে, এই খবর টাও বোধহয় তিনগ্রামে ছড়িয়েছে, কিন্তু এবার
আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া লাগেনি।
(চলবে …)
#বিয়েনামা_৩
#বিয়ের_আগের_যত_ক্যাঁচাল
(৯)
আজ ঘরে আমাকে ঘিরে সভা হচ্ছে। আমি আসামী, প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বাবা। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সকল অপরাধের মামলা ও দায়ের করেছেন স্বয়ং প্রধান
বিচারপতি নিজে। আমার পক্ষে উকিল হিসেবে আছেন মা। যদিও এটা স্বীকৃত নয়, তবুও আমি জানি,
মা আমার পক্ষে ওকালতি করবেনই। বিচারকার্য শুরু হল। বাবা বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলা শুরু করলেন,
-মান-ইজ্জত তো
আর একেবারে রাখলি না।
-আমি তো দেখাই করতে চাচ্ছিলাম না।
“আমি তো দেখাই করতে চাচ্ছিলাম না”
বাবা ফের আমার কথার ব্যঙ্গ করলেন।
-নাচতে নাচতে বের হয়ে গেলি। মেয়ের নাম কি, নাম্বার কি, কোথায় দেখা করবে না করবে কোন খোঁজ নেই!
-ছাড়েন না, পুরনো
কথা উঠিয়ে কি লাভ হবে।
মায়ের চিকন সুর! সূত্রমতে বাবার এখনি শান্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ সূত্র খাটলো না। বাবা দ্বিগুণ তেজে চেঁচিয়ে উঠলেন।
-পুরনো কথা? আরে,
হাসাহাসি পড়ে গেছে ও বাড়িতে আমাদের কে নিয়ে। কোন ইজ্জত থাকবে আর?
-ইজ্জত হয়ে যাবে। সম্বন্ধ হোক আগে।
আমি অপেক্ষা করছি বাবা আমার কথা পুনরায়
ব্যাঙ্গ করবেন বলে। এবং করলেন।
“ইজ্জত হয়ে যাবে! এত সহজ! মেয়ের কাছে, মেয়ের বাবার
কাছে, মেয়ের বোনের কাছে পর্যন্ত হাঁদারাম বনে গেলি আবার ইজ্জত
হয়ে যাবে”
আমি বিচারের মাঝখানে কোর্ট ত্যাগ করার
সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবার ক্যাঁচাল আর ভাল
লাগছে না। বাবাও চুপ হলেন, আমি উঠে চলে এলাম। আপাতত সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়ে করে নেব, মেয়েকে আর দেখার প্রয়োজন নেই,
যা হওয়ার হবে। তবে এ কয়দিন যা চলছে, তাতে তারাই বিয়ে ভেঙে দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ইতিমধ্যে এই পাত্র তাদের কাছে হাসির পাত্র বনে গেছে। তাই আর তারা এগুবে বলে
মনে হচ্ছে না।
(১০)
আমাদের পক্ষ থেকে গ্রিন সিগনাল পাঠানো
হয়েছে ও বাড়িতে। সিদ্ধান্ত টা আমারই, বিয়ে এখানেই করব, আর যাই হোক। আর নাহয় বিয়েই করব না। কারণ এ কয়দিনে বিয়ের চক্করে যেসব
পরিস্থিতিতে পড়েছি তাতে, বিয়ে করার আগেই বিয়েকে
ঘৃণা করা শুরু করে দিয়েছি। এর পরে যদি এখানে বিয়ে না করে অন্য
কোথাও আবার পাত্রী দেখতে যেতে হয়, তাহলে আবারো
হয়ত এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। আর বাবা তো তখন হার্ট এটাক করবেন, চোখ বড়
করে বলবেন, “আরো একটা চেইন?”
আর আমি মেয়েকে নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত
না। এমন না যে “মেয়ে যেমন ই হোক, কালো হোক, অসুন্দর হোক, মানুষ তো! আমি বিয়ে করে
নেব” টাইপ মহাপুরুষ আমি। আমি বরং কিছুটা ভরসা পাচ্ছি, বাবা খুঁতখুঁতে মানুষ,
যেখানে বাবার পছন্দ হয়েছে সেখানে আমার পছন্দ না হয়ে কই যায়। ভাগ্যিস, মাকে নিয়ে
যাইনি! নাহয় আমার পছন্দের বারোটা বেজে যেত। সেই হলুদ আর সবুজে মেশানো রঙিন
পাঞ্জাবি টার কথা হবে ঢোক গিললাম দুবার।
যাহোক, খুশির খবর হচ্ছে মেয়ের বাড়ি
থেকে গ্রিন সিগনাল এসেছে। এটা আমার জন্য আশ্চর্যজনক, আমি ভেবেছিলাম তারা এগুবে না।
কিন্তুর বাবার মতামত ভিন্ন। তিনি একটি গবেষনা প্রতিবেদন পেশ করলেন আমার সামনে।
-হিসেবে তো তারা জিতলই। জামাই ভাল
বেতন পায়, লম্বায়-সুন্দরে কোনদিকে কি কমতি আছে নাকি? ইঞ্জিনিয়ার জামাই কেউ হাতছাড়া
করতে চায়না বুঝলি?
-হ্যাঁ। আর বোকা জামাই হাত করে রাখতে
পারবে ভেবছে বোধহয়, হা হা হা!
আমি অট্টহাসি দিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে
মনে হল কথাটা খানিকড়া ইঁচড়ে পাকামির মত শোনাচ্ছে। বাবা না হেসে বরং গম্ভীর হয়ে
গেলেন। চেহারা দেখে মনে হল, মনে মনে বলছেন, “পাগলের প্রলাপ যতসব!” আর এদিকে বিয়ের
মোটামুটি কনফার্মেশনের পর থেকে মায়ের ভিন্নরূপ দেখতে পাচ্ছি। মা কিছুক্ষণ পরপর এসে
আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কিভাবে বউকে হাতে হাতে রাখতে হয়,
শাসনে রাখতে হয়।
-শোন, বউকে দেখে দেখে রাখতে হয়। নাহয়
এদিক ওদিক চলে যাবে, বুঝিস তো?
-মা! বউ কোন গরু না, আর আমিও কোন
রাখাল না। তার মনে আল্লাহর ভয় থাকলে সে নিজেই ঠিক থাকবে, আর আমিও তো এমন ছেলে না,
সে দেখবে না?
মা নিরুৎসাহিত হন আমার কথাবার্তায়।
মাঝেমাঝে এসে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। “বউ আসার পর মানুষ মা
কে চিনে না। বুঝছিস?”
-কেন? বউ মানুষের স্মৃতি খেয়ে ফেলে?
-সব কিছুতে মজা নিস কেন? দেখা যাবে
বিয়ের পর মায়ের কেমন খেয়াল রাখিস। নাকি বউয়ের পক্ষ নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করবি?
-তার মানে তোমার মনে অলরেডি স্থির
হয়ে গেছে যে তুমি বউ এলেই ঝগড়া করবে? এখন শুধু আমি কোন সাইডে থাকব সেটা স্থির করা
বাকি?
-কি বললি? আমি ঝগড়াটে! বউ আসার আগেই
আমাকে অপমান করছিস। না জানি বউ এলে কি করবি!
মায়ের কথায় আমি থ হয়ে গেলাম। সত্যিই
মহিলাদের আইকিউ জিরো হয়। এবং তাদের মনের মধ্যে যেটা চলছে সেটার সাথে যেকোন কথাকে
রিলেট করে ফেলতে পারেন। এই যেমন মূহুর্তে আমাকে কতবড় পাপী সন্তান বানিয়ে দিলেন।
আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে না পেরে বসা থেকে উঠে গেলাম।
(১১)
আজ আমার বিয়ের ফর্দ! বিয়ে সম্পর্কে
সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ আমি বাবার নেতৃত্বে অন্যান্য মুরুব্বীদের সাথে আমার ফর্দের
অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। বাবা আমাকে কম কথা বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন আজ মুরুব্বীরা
কথা বলবে, আমি যেন চুপ থাকি। আমি বাবার কথামত নিজেকে চুপ রাখার চেষ্টা করছি। আজও
মায়ের পছন্দের পাঞ্জাবি পরে এসেছি। ফর্দ হচ্ছে ‘ফুড ফান’ হোটেলে। দুপক্ষ থেকে অনেক
মুরুব্বী এসেছে। মেয়ের বাবা বারবার আমাকে দেখছেন। আমি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে
রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কিনা সেটা দেখার চক্করে
কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেছে। চোখাচোখি হয়ে আমার এক্সপ্রেশন এমন হয়েছে যেন সদ্য উনার
ঘরে সিঁদ কেটে ঢুকতেই উনার সামনাসামনি পড়ে গেছি। মুরুব্বীদের মধ্যে বিয়ের বিভিন্ন
বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি চুপচাপ এক কোণে বসে আছি। দেনমোহরের আলোচনা আসতে আমাকে
ডাকা হল। কোণা থেকে উঠে এসে সবার মাঝখানে এসে বসলাম। সবাই আমার দিকে এমন ভাবে
তাকিয়ে যেন তারা একেকজন এজেন্ট আর আমি কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানির ক্যাশিয়ার। দরদাম
চলছে বিভিন্ন, এর মধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কয়েকবার করে। আমি বাবার শেখানো
পদ্ধতি মত হুঁ হাঁ করছি। এবার তাদের মধ্য থেকে এক মুরুব্বী রেগে গেলেন।
-জামাই কথা বলে না কেন?
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন।
এবার আমি শুরু করলাম। কিন্তু এত জনের সামনে কি বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ
মনে পড়ল বিসিএসের সেই ভাইভার কথা! এক লোক এতটাই নার্ভাস ছিল, ভাইভা রুমে ঢুকার
জন্য দরজা ফাঁক করে কি বলে অনুমতি চাইবে সেটাই ভুলে গেছিল, অনেকক্ষন চুপ থাকার পর
সে বলে উঠল “আল্লাহু আকবর!” ভাইভা বোর্ডে সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। আর ক্যান্ডিডেট
এটা বলেই পালিয়ে গেল। কথাটা মনে পড়তেই
হঠাৎ “হা হা হা” বলে হেসে দিলাম। ভরা মজলিশে সবাই যখন চুপ তখন এক বিকট হাসির শব্দে
সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। সাথে সাথে বাবার
দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখ হা হয়ে গেছে, চোখ অস্বাভাবিক রকমের বড়। পরিস্থিতি
সামাল দিতে এক কাকা বলে উঠলেন, “তো দেনা পাওনার কথা আগে বাড়াই তাহলে” মজলিশে
পুরোপুরি প্রাণ ফিরে না এলেও সবার হতভম্ব ভাবটা কিছুটা কাটল এতে। সবাই আলোচনা আবার
শুরু করল। আমি মাঝখান থেকে বলে দিলাম, “আমি দেনমোহর নগদ দিতে চাই” উপস্থিত সবাই
আমার দিকে তাকালো। বাবার চোখ আরো বড় হয়ে গেল। সবাই অবাক হওয়ার কারণটি স্পষ্ট। আমাদের সমাজে এ জিনিসটি প্রচলিত নয়। অথচ ইসলামে দেনমোহর নগদ দিয়ে
দেয়াটাই নিয়ম। সবাই আমার কথা শুনে ফিসফিস করতে লাগল।
-দেনমোহর আমি নগদ দিতে চাই। কিন্তু আপনারা যেভাবে বলছেন, সেভাবে তো সামর্থ
হবেনা। আমি যে চাকরি করি তাতে আরো দু-তিন বছর লেগে যাবে শুধু দেনমোহরের টাকা জোগাতে।
-তাই বলে কি আমরা মেয়েকে নামেমাত্র
মূল্যে দিয়ে দিব?
-মেয়ে বিক্রি করছেন আপনি? এটা তো বেচা-কেনা না। বিয়ে করব তাকে, সারাজীবনের সঙ্গী হবে। আর এ দেনমোহর তার হক্ব, তার উপহার, এটা তো তার দাম না।
আমার জ্ঞানগর্ভ কথায় কেউ সন্তুষ্ট হল
না। মেয়ের বাবার তো চোখে আগুন। ছেলে মুখে মুখে কথা
বলছে। তারা অনড় হয়ে রইলেন, ছয়
লাখের কমে দেনমোহর হতে পারবেনা।
-কিন্তু দেনমোহরের ব্যাপারে নির্দেশ
হচ্ছে স্বামীর সামর্থ্যনুযায়ী।
আমার এ কথার কেউ জবাব দিল না। এবার আমার মেজাজ বিগড়ে গেল।
-আমি দেনমোহর নগদ প্রদান করতে চাইছি
এখানে আপনাদের বিভিন্ন ধরণের মনোমালিন্য। এই ছয়লাখ টাকা দেনমোহর
ধার্য করবেন, এরপর স্ত্রী সেটা মাফ করে দিবে,
এটায় আপনাদের কোন দাবি নেই। এটা খুবই শুদ্ধ।
এদিকে আমি বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য
দিয়ে চলেছি, অন্যদিকে বাবার চোখ ক্রমে বড় হচ্ছে। বাবা বোধহয় আমার এই রূপ প্রত্যাশা করেননি। মেয়েপক্ষ ও নিশ্চয়ই
খুব অবাক হয়েছে। হাঁদারাম জামাই এ ধরণের কথা বলেছে, এটা নিতান্তই আশর্য হওয়ার মত ব্যাপার। কিছুক্ষণ পর মেয়ের পক্ষ থেকে একজন মুরুব্বী এগিয়ে এলেন সমঝোতার জন্য। আরো প্রায় দুঘণ্টা বাকবিতণ্ডার পর মোহর দুলাখ টাকা ধার্য হল। আর এটা আমার যেমন দুঃশ্চিন্তার কারণ হল, তেমনি
বাবার হল প্রেশার বাড়ার কারণ। বাড়ি আসার পর মায়ের কাজ বেড়ে গেল, তেল আর পানি মিশিয়ে বাবার মাথায় ঘষতে বসে গেলেন। আর আমি কাঁথার নিচে গিয়ে লুকোলাম। আজও না দরজা ভেঙে বের করা লাগে এজন্য
দরজা খোলাই রাখলাম। তবে আজ নিজের উপর গর্ব হচ্ছিল, একটা ন্যায় কথা বলেছি, কিন্তু টাকার দুঃশ্চিন্তায়
ঘুম আসা দায় হয়ে পড়েছিল।
(১২)
বাবার প্রেশার বরাবরই উর্ধ্বগামী। এদিকে বিয়ের দিন তারিখ ঘনিয়ে আসছে, কাজের
সমুদ্র। বাবা তৈলাক্ত মাথা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছেন, একে ফোন করছেন, ওকে ফোন করছেন। আমিও বাবার কাজে কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করছি। বাবার ফোনে নিয়মিত রিচার্জ
করে দিচ্ছি, তেল ফুরিয়ে গেলে তেল কিনে দিচ্ছি,
আর সচরাচর বাবার সামনে পড়ছি না। রাতে আবার এসেম্বলি
কল করা হল। বাবা এবার স্পীকার, আর আমরা সংসদ সদস্য। আমি, মা, ছোট ভাই, বোন,
বোনের স্বামী, আর তিন মামা। আলোচনার শুরুতে বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে নিলেন, এটা বাবা রোজ করে থাকেন।
-এমন একটা বিয়ে হচ্ছে যার আগাও নাই,
মাথাও নাই।
-আজও নিরাশামূলক বক্তব্য না দিলেই নয়?
আমি সাথে সাথে অবজেকশন জানালাম। বাবাও বোধহয় স্পিচ রেডি রেখেছিলেন।
-না বলে কি করব? বিয়ে করছিস অথচ মেয়ে দেখিস নি, ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে
তিন গ্রামের মানুষ হাসাইছিস, মেয়ের জায়গায় মেয়ের বোনকে দেখে এসেছিস,
দেনমোহরের দু লাখ টাকা কোত্থেকে দিবি সেটা ভেবেছিস? তার উপর বিয়ের এত খরচ!
-তিন গ্রামের মানুষ আমার স্ট্যাটাস
দেখেছে কে বলল? আমার ফ্রেন্ডলিস্টে মাত্র ১৪০০ বন্ধু,
তার মধ্যে অধিকাংশই শহুরে। আর আমি তো মেয়ের বোন
কেও দেখিনি, তার মুখ ঢাকা ছিল, নাম জেনেছি শুধু, সালমা। আর দেনমোহরের টাকা আজ
নাহয় কাল তো দিতেই হবে।
বাবা আমার থেকে উত্তর আশা করেছিলেন বলে
মনে হয়না। তবে উত্তর পেয়ে তার মুখে দ্বিগুণ বিরক্তি চড়ে গেল। যাহোক, সে বৈঠকে কাকে কাকে দাওয়াত করা হবে,
কিভাবে সব আয়োজন হবে, বিয়েতে কি কি লাগবে,
কেমন খরচ পড়বে, এসব একেবারে খাতা-কলমে হিসেব করে তবেই উঠলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, বিয়ে না করে এই টাকা ব্যবসায় খাটালে বোধহয় একবছরে মূসা বিন শমসের
হয়ে যেতাম। বিয়ের আর দু থেকে তিনদিন বাকি। বিয়ের আগের রাতগুলো একজন তরূণের স্বপ্নের রাত তবে একই সাথে বিভ্রান্তিকর ও! বিয়ের পর রাতে আমি খাটের কোনপাশে শুবো এটাই ভেবে পাচ্ছিনা। যদি ডানপাশে ঘুমাই তাহলে খাট থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, কেননা এর আগেও এমন অনেক ঘটেছে। আর যদি বামপাশে ঘুমাই, তাহলে ফ্যানের বাতাস ভাল পাবনা। সারাজীবন স্যাক্রিফাইস
করব নাকি? কিজানি! ছাইপাশ ভাবতে
ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
(১৩)
বিয়ের আয়োজন চলছে ধূমধাম করে। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে বাবার প্রেশার কিছুটা কমেছে। আয়োজন প্রায় শেষ। বাড়িতে প্রচুর মেহমান। কাজিন ভাইরা এসে তো আমাকে ঘিরে কত
রকমের কথা। সবাই যার যার মত মজা করছে। কিন্তু আমার ভেতরে নার্ভাসনেস
ঢুকে গেছে। কাল আমার বিয়ে। কিভাবে কি হবে? চাচাতো ভাই জুমেল বলল,
-কিরে? কেমন বোধ
করছিস?
-খুবই নার্ভাস! কাল কি ধরণের আচরণ করতে হবে ভেবে পাচ্ছিনা।
-কেন রে? এত নার্ভাস
কেন? বিয়েই তো।
-আরে! আগে কখনো
বিয়ে করেছি নাকি? কোন এক্সপেরিয়েন্স নাই, কি করতে হবে না করতে হবে, ফর্মালিটিস কিছুই জানিনা।
-তুই শুধু মুখে রুমাল গুজে বসে থাকবি
আর কিছু করা লাগবে না।
-রুমাল গোজা টা কি গুরুত্বপূর্ণ।
-তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বলেই জুমেল হাসতে হাসতে অন্যদিকে চলে
গেল। আর এদিকে আমি ইউটিউবে ঢুকলাম। ঢুকেই টিউটোরিয়াল সার্চ
করতে লাগলাম। “How to be
a smart groom” ফলাফল হিসেবে আসল, “How to dress for your
wedding” আমি স্কিপ করে মনে মনে বললাম, “না ভাই
থাক! আমার মা আছে!”
বলে নিজেই হাসতে লাগলাম।
সন্ধ্যা হতে হতে বাড়িতে মেহমান ভর্তি
হয়ে গেল। চারদিকে হৈচৈ চলছে। আমি আমার রুমে একা বসে
আছি। ভাবছি ফেসবুকে কাল আমার বিয়ে নিয়ে কোন গুরুগম্ভীর স্ট্যাটাস
দিব। কিন্তু পুর্ববর্তী ঘটনা মনে করে আর মন এগুলো না। এদিকে কাজিন সিস্টার রা হৈ হৈ করে মেহেদী নিয়ে ছুটে এল। একজন তো বেশ উত্তেজিত
হয়ে বলল, “ভাইয়া মেহেদী!”
আমি বললাম, “আরে, তোমরা মেহেদী লাগালে অন্য রুমে গিয়ে
লাগাও না, এখানে কেন?”
সবাই আমার দিকে হা করে চেয়ে রইল। আমি বুঝতে পারলাম ওরা আমাকে মেহেদী লাগাতে এসেছে। অগত্যা উপায় না দেখে
বসলাম একেবারে ফ্লোরে আসন পেতে। দুই বোন দুই হাতে মেহেদী লাগাল। আমার প্রায় ঘুম এসে যাচ্ছিল। খাটের পায়ার সাথে হেলান দিয়ে রইলাম। দুঘণ্টা পর চোখ খুলে বললাম, “হয়েছে রে?”
বোন বলল, “একটা পাতা হয়ে গেছে”
তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি একটা পাতাই আঁকা হয়েছে। মেজাজ তিরিক্ষ্ণি হয়ে গেল। অসম্পূর্ন মেহেদী নিয়েই বেসিনে গিয়ে
হাত ধুয়ে ফেললাম, এতে হল উলটো। মেহেদী না শুকানোর কারণে লেপ্টে গেল আর লাল রঙ পুরো হাতে ছেয়ে গেল। এটা দেখে ইচ্ছে করছিল নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে দিই। ছোটবোন গুলা ভয়ে দৌড়ে
পালাল। জুমেল এসে বুঝাতে লাগল, “পড়বি
তো ফুল হাতা পাঞ্জাবি, দেখা যাবেনা, ব্যাপার
না”
এর মধ্যে মামাতো ভাইয়েরা ছুটে এল, “চল ভাইয়া তোমাকে কোলে করে গোসল করাই দি”
-কেন? আমি নিজে
গোসল করতে পারিনা? আর সকালেই তো করলাম। কয়বার করব গোসল?
-বিয়ের আগের রাতে গোসল করতে হয়।
সবাই সমস্বরে বলল।
“ঠিক আছে” আমি
ঘর থেকে লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে চললাম। পেছন পেছন সবাই হলুদ, বালতি, সাবান নিয়ে চলল। আমি গিয়ে সোজাসুজি পুকুরে নেমে ডুব দিয়ে উঠে এসে গা মুছতে শুরু করলাম। আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা, আমার
যেকোন কাজেই সবাই হা হয়ে যায়। এটাকে আমি আমার সুপারপাওয়ার হিসেবে
ধরে নিয়েছি। তবে সবার চেহারা দেখে মনে হল সবাই মনক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ নিয়ে আবার বাবার দরবারে বিচার বসে কিনা কে জানে!
আমি গোসল সেরে দৌড়ে গিয়ে কাঁথার নিচে
লুকালাম। এর মধ্যেই শুনতে পেলাম বাবা বন্ধুসুলভ ভাবে কার সাথে
যেন কথা বলছে। বাবা এতটা সুন্দর আচরণ তো কারো সাথে করেনা। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এটা আমার হবু শ্বশুর, আর বাবা এজন্য বেশ মিষ্টি মধুর আচরণ করছেন। বাবার কণ্ঠ ধীরে ধীরে
নিকটবর্তী হচ্ছে, হঠাৎ দেখি বাবা রুমে
এসেই হাজির হয়েছেন।
-জ্বি, এইতো আছে, দিচ্ছি কথা বলেন।
বাবা কথার মিষ্টতা বজায় রাখার জন্য
মুখেও একটা মধুর হাসি এনেছেন। ফোনটা আমাকে এগিয়ে দিতে দিতে এক্সপ্রেশন বদলে
সতর্কতা জারিমূলক এক্সপ্রেশন দিলেন। আমি বাবার ইঙ্গিতের অর্থ বুঝতে পারলাম না। ফোন
নিয়েই সালাম দিলাম।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। বাবা, ভাল আছো?
-জ্বি ভাল আছি। আপনি?
-আমিও ভাল আছি আল্লাহর রহমতে।
-হুম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি ফেসবুকে
অপরিচিত কারো সাথে চ্যাট করার স্টাইলে শ্বশুরের সাথে কথা বলে ফেলেছি। তাঁর “আমিও
ভাল আছি আল্লাহর রহমতে” কথাটার উত্তরে আমি বলে ফেলেছি ‘হুম’। তিনি বোধহয় খেয়াল
করেননি। তিনি নিজে থেকেই বলছেন,
-দোয়া করি আল্লাহ সহীহ সালামতে আনুক।
আমি তাঁর কথার মাঝখানেই বললাম, “আমি
শেরওয়ানী না পড়লে কি হবে? আসলে শেরওয়ানী পড়লে আমার আরাম লাগেনা মোটেই। অস্বস্তি
লাগে”
-কিন্তু বাবা, শেরওয়ানী না পড়লে লোকে
কি বলবে।
-আচ্ছা শেরওয়ানী ঠিক আছে। অন্তত ঐ
মুকুট পরার জন্য বলবেন না, মুকুট পড়লে আমাকে কেমন দেখায় জানেন? সিরাজঊদ্দৌলা ছবিতে
আনোয়ার হোসেন কে যেমন লাগে ঠিক তেমন।
-হা হা হা। ঠিকাছে। তোমার যেমন ইচ্ছা।
আমি ফোনে কথা বলছি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমার খেয়াল নেই। কথা শেষ করে ফোন বাবাকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখি বাবা নিচে পড়ে গেছে। বুঝতে পারছিনা হঠাৎ করে কি হল। তবে এটুকু ধারণা করতে পারছি বাবা আমাকে আনোয়ার
হোসেনের চরিত্রে মূহুর্তের মধ্যেই কল্পনা করে মূর্ছা গেছেন। মায়ের দায়িত্ব বেড়ে
গেল। তেলে-পানিতে মিশিয়ে বাবার মাথায় মালিশ চলছে, আমি ততক্ষণে কাঁথার নিচে পুনরায়
লুকিয়ে পড়েছি।
(১৪)
আজীবন বাংলা সিনেমায় বিয়ে বাড়ি মানে পেঁ
পেঁ শব্দের বিভিন্ন ভুভুজেলার আওয়াজ, বাচ্চাদের
এদিক ওদিক ছোটাছুটি, আর লাল-নীল-সবুজ কাগজে সাজানো বাড়ি দেখেছি। ভেবেছিলাম পেঁ পেঁ ব্যান্ড
পার্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙবে। কিন্তু ঘুম ভাঙল মায়ের চেঁচামেচিতে, রোজকার মত আজও বোঝা যাচ্ছিল না মা আসলে কি বলছিলেন। ঘুম থেকে উঠেই বেসিনে গিয়ে
ব্রাশ আর পেস্ট হাতড়াতে লাগলাম, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না। মা হাতে একটা শপিং ব্যাগ
নিয়ে আসলেন, গোলা থেকে ধান হাতড়ানোর মত করে একটা টুথব্রাশ আর কোলগেটের একটা
টুথপেস্ট বের করে আমার হাতে দিলেন।
-পুরনো গুলো ফেলে দিছি। আজকে দিনে
নতুন ব্রাশ।
-পেস্ট টা না বদলালেও পারতে। কোলগেট
দিয়ে দাঁত মাজলে মুখ তেতো হয়ে যায়।
মা আমার হাতে ব্রাশ আর পেস্ট দিয়ে
চলে গেলেন। আমি কোলগেট দিয়ে দাঁত মেজে মুখ তেতো করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে রইলাম।
আজকাল ফোন হাতে নিলেই আমার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে মন চায়। এখন মন চাচ্ছে
স্ট্যাটাস দিই, “Feeling excited” “ আজ
আমার বিয়ে” সাথে সানগ্লাস আর লাভ ইমোজি। কিন্তু কমেন্টে উত্ত্যক্তকারীরা কি ধরণের কমেন্ট করবে সেটা ভেবেই ফোনটা হাত থেকে
নিচে নেমে এল। নাস্তা সেরে গোসল করে বসে রইলাম। বাবা হাওয়ার বেগে এদিক ওদিক ছুটছেন, কত
ব্যস্ততা তাঁর! কাল সারারাত মাথায় আধাকেজি পরিমাণ তেল ঘষার পর
তিনি সচল হয়েছেন। কিন্তু সকাল থেকে আমাকে দেখে কোন কথা বলেননি। আমাকে দেখে বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন, আমিও
কম যাই না, আমিও এড়িয়ে যাচ্ছি। বাবা আর আমি যেন সরকারী
আর বিরোধী দল। যাহোক, আয়নার
দিকে তাকিয়ে মোটেও বর বর একটা অনুভূতি পেলাম না। সবসময় নিজেকে বরযাত্রী
বরযাত্রী লাগে। যেমন নিজেকে একটুও নায়ক নায়ক বানাতে পারিনা, সবসময় সাইড নায়কের মত লুক হয়। কিন্তু আজ তো আর তেমন
হলে চলছে না। আজ তো আমিই বর, আমিই নায়ক। তাই চাচাতো ভাইদের ডেকে এনে বললাম,
“সাজিয়ে দে দেখি আমাকে”
শুনেই সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খেল। একজন বলল, “ভাইয়া পার্লারে যাবেন? ওরা আপনারে একদম সুন্দর করে সাজাই দিবে” কথাটা শুনে আমার
মেজাজ বিগড়ে গেল। পার্লারে সাজতে যাব কেন? পার্লারে যাবে তারা যাদের রূপ নাই, মুখের
উপর আস্তরণ বসিয়ে রূপ আনতে যাবে পার্লারে, আমি কেন যাব?
-যা বাদ দে। সাজা লাগবে না আমার। এমনিই ঠিকাছে।
সবাইকে তাড়িয়ে “বিয়েতে কি সুন্দর দেখাতেই হবে?” টাইটেলে
একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস লিখে ফেলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পূর্ববর্তী ঘটনা
মনে করে চুপসে গেলাম, আর মনে মনে ভাবলাম,
“আহারে! বিয়ের আগেই এত পরাধীন হয়ে গেছি মনমত স্ট্যাটাস
ও লিখতে পারছি না!” মনের মধ্যে আবার আগুন জ্বলে উঠল। এবার “পুরুষের পরাধীনতা” টাইটেলে
জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস লিখে ফেলতে লাগলাম। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগেই
কন্ট্রোভার্সিয়াল কিছু করে ধরা খেতে চাইছিলাম না, তাই গুগলে সার্চ করলাম, “How to control mind” এসব করতে
করতে বেলা প্রায় অনেক হয়ে গেল। বাবা রেডি হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু
করেছেন। তাই তড়িঘড়ি করে রেডি হলাম।
(১৫)
সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়ে, অনিচ্ছাস্বত্তেও খয়েরি রঙের বিশদ একটা শেরওয়ানী পড়ে আয়নার সামনে
দাঁড়ালাম। নিজেকে অস্বাভাবিক রকম স্বাস্থ্যবান লাগছে, যাক শেরওয়ানীর কিছু অন্তত উপকারিতা পেলাম। মুখে একটু হাসি হাসি ভাব এনে আয়নায় নিজেকে পরখ করছি। আমাকে এমন একটা এক্সপ্রেশন
আবিষ্কার করতে হবে যেটাতে আমাকে সুন্দর দেখাবে। আর এই এক্সপ্রেশন টা
আমাকে মাথায় সেট করে নিতে হবে। আজ পুরোদিন ঐ এক্সপ্রেশনের উপর থাকতে
হবে। তাই বিভিন্ন এক্সপ্রেশন চেক করে নিচ্ছিলাম। কোথা থেকে মা এসে “দেখি দেখি নতুন জামাইকে”
বলে আমার মাথায় হাত বুলালো। হাত বুলানো পর্যন্তই
ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরই একদলা থুথু মুখে মেখে দিল।
-নজর না লাগুক আমার মানিকের!
-এটা কি খুব প্রয়োজনীয়?
আমি প্রচণ্ড রাগ চেপে রেখে বললাম।
-থুথুতে নজর কাটে বাবা।
মাকে বোঝানো আমার কাজ নয় ভেবে আর কিছু
বললাম না। মুখ ধুয়ে এসে আবার এক্সপ্রেশন চেক করতে লাগলাম। এর মধ্যে একটা হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছে, গাড়ি
এসে গেছে। বের হয়ে যেতে হবে। আমি রুম থেকে বের হয়ে
এলাম। বাবা বলল,
-তোর মাথা খালি কেন? একটা টুপিও দিবি না?
আমি সাথে সাথে সোফার উপর পড়ে থাকা একটা
টুপি মাথায় দিয়ে বিজয়ের হাসি দিলাম।
-খয়েরি ছাড়া ম্যাচ হচ্ছে না। বাজার থেকে নিতে হবে একটা।
-এজন্যই আমি শেরওয়ানী পড়তে চাইনি। কাউকে দেখেছেন কোনদিন খয়েরি টুপি পরে বিয়ে করতে যেতে?
-শেরওয়ানী পরে মুকুট ছাড়া কাউকে বিয়ে
করতে দেখেছিস কখনো।
বাবার যুক্তির সাথে টিকে উঠতে পারবনা
দেখে চুপ করে গেলাম এবং বাজার থেকে খয়েরি টুপি কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত বাই ডিফল্ট মেনে
নিতে হল।
আমি বের হওয়ার আগে বাবাকে পাঁ ছুয়ে সালাম
করলাম, এরপর মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করার সাথে সাথে মা
বিলাপ জুড়ে দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
-মা! আপনি ভুল
রোল প্লে করছেন। আপনি তো ছেলের মা। কাঁদবে তো মেয়ের মা। ভুলে গেছেন?
বাবা আমার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকালেন। আমি ঢোক গিললাম। জুমেল কানে কানে বলল, “এটা নিয়ম”
আমিও মাকে কানে কানে বললাম, “আপনি কি নিয়মের খাতিরে কাঁদছেন নাকি আপনার আসলেই কান্না আসছে”
প্রশ্নটা বেয়াদবির পর্যায়ে চলে যাবে বলে আমি খুবই ক্ষীনস্বরে বললাম,
মা শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। এরপর মায়ের হাতে পানি
খাওয়া, শরবত খাওয়া, চাল নেয়া,
অনেক রীতিনীতির দুয়ার পার করে তবেই ঘরের দুয়ারের ওপাশে পা রাখলাম।
(১৬)
গাড়িতে উঠেই আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে চাইলাম, পরে মনে হল আমি তো
বর। তাই চুপচাপ পেছনে বসে গেলাম। গাড়ির মধ্যে শুধু ফুলের
গন্ধ, মনে হচ্ছিল এই গন্ধেই না বমি করে দিই,
পরে নতুন কেলেঙ্কারি। আমার পাশে বসল, বোনের স্বামী আর জুমেল। সবাই নানারকম কৌতুক
বলতে বলতে গাড়ি চলল। এদিকে আমি ড্রাইভারের লুকিং ক্লাসে নিজের এক্সপ্রেশন
খুঁজতে লাগলাম। বাজারে এসে গাড়ি থামল। কিছুক্ষণ পর দেখি বাবা
খয়েরি রঙের একটা টুপি নিয়ে এসেছেন। আমি ভেবেছিলাম টুপি কিনতে বুঝি
আমাকেও ডাকবেন।
-টুপি টার উপরের দিকে এই সুতো গুলো
কেন?
-এটায় একটা মুকুট মুকুট ভাব আছে।
বাবা একেবারে গর্বের সহিত বললেন।
-আমি বাচ্চাকালে পরেছিলাম এই টুপি,
এখন পরব এটা?
বাবা আমার কথা পাত্তা না দিয়ে চলে
গেলেন। এদিকে আমাকে এই টুপিতে কেমন হাস্যকর দেখাচ্ছে সেটাই আমার টেনশনের কারণ হয়ে
দাঁড়ালো। এদিকে গাড়ি খুব আস্তে আস্তে চালাচ্ছে। মেজাজ টা বিগড়ে যাচ্ছে।
-কি ভাই? আপনার গাড়ি এত স্লো কেন?
-যাইতে দশ মিনিট লাগে। আফনে দুলা না?
এত তাড়াতাড়ি যায়া কি করবেন?
-যেয়ে কি করব মানে? বিয়ে না? বিয়ে
করব। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে আবার।
ড্রাইভার আমার কথায় থ মেরে গেল। আর
খানিকটা স্পিড বাড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মেয়ের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। গেটের বাইরে
গাড়ি দাড় করানো হল। গেটে অনেক মানুষজন। পিচ্চি পিচ্চে ছেলেমেয়েরা গাড়ির আশেপাশে
জড়ো হয়েছে, কালো গ্লাস দিয়ে আমাকে দেখা যাচ্ছে না। একটা সেলেব্রিটি সেলেব্রিটি
অনুভূতি পাচ্ছি। ছেলেমেয়ে গুলো চারপাশে এমনভাবে জড় হয়ে আছে ওদেরকে দেখে ইংলিশ
মুভিতে দেখা জোম্বি দের মত লাগছে। এক মুরুব্বী এসে সবাইকে সরিয়ে দিলেন। এরপর এসে
গ্লাসে নক দিলেন। এই মুরুব্বী সম্ভবত মেয়ের চাচা। গ্লাস নামালে উনি আমাদের কে বের
হতে বললেন। আমার কাছে গাড়ির বাইরের জগত টাকে মনে হচ্ছে কোন জেল, ফর্মালিটির বাঁধন,
গাড়ি থেকে নামলেই খপ করে ধরে ফেলবে, ফর্মালিটি আর রেস্পন্সিবিলিটি। তাই মনে হল,
আরো কিছুক্ষণ থাকিনা, কারাবাসে কিছু বিলম্ব হোক।
(১৭)
গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে দাঁড়াতেই
কিছু ছেলেমেয়ে গেটের মুখে টেবিল বসিয়ে অবরোধ করল। টেবিলে দু গ্লাস শরবত আর একটা
প্লেটে ৩টা মিষ্টি। মিষ্টির প্রতি আমার আজন্ম দুর্বলতা! বোনের স্বামী কে আমি
সালমান ভাই বলে সম্বোদন করি। তাঁকে কানে কানে বললাম, “ভাই, এত দুর্বল মেহমানদারী!
মাত্র দুগ্লাস শরবত আর তিনটা মিষ্টি!” সালমান ভাই মৃদু হাসলেন, তার হাসির অর্থ
সবাই দেখছে, পরে কথা বলি। তো আমাকে চেয়ারে বসানো হল। প্রত্যেক বিয়েতে একজন
অতিপাকনা শ্যালক আর অতিপাকনা শ্যালিকা থাকে। তো সেই অতিপাকনা শ্যালিকা আমাকে বলল
“দুলাভাই শরবত খান” আমি লজ্জাবোধ করলাম না। প্রথম গ্লাস চুমুক দিয়ে দেখি কড়া। আমি
বললাম, “তোমরা কি শরবতে লবণ দিয়েছো? এত কড়া কেন?”
সবাই জোরে জোরে হেসে উঠল। ঐ গ্লাস
রেখে আমি অন্য গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। এই গ্লাসের শরবত তেতো।
-দেখো, একটা কড়া, একটা তেতো। একটা
গ্লাস তো অন্তত মিষ্টি শরবত রাখা প্রয়োজন ছিল।
সালমান ভাই আমাকে চিমটি কাটলেন,
কিন্তু আমি লজ্জাবোধ করলাম না। কারণ আমার কথায় যুক্তি ছিল। এরপর শ্যালক-শ্যালিকারা
আমাকে কাটাচামচের আগায় খুবই সূক্ষ্ম পরিমাণে মিষ্টির কণা নিয়ে আমাকে খাইয়ে দিল।
এতে আমার মিষ্টি খাওয়ার হায়েস পূরণ তো হলই না, বরং আরো বিরক্ত লাগল। অগত্যা আমি
নিজেই একটা মিষ্টি উঠিয়ে মুখে পুরে নিলাম।
-গ্লুকোজ প্রচুর। ব্রেনের জন্য ভাল।
আমি হাসিমুখ বজায় রাখতে রাখতে বললাম।
এরপর শ্যালক-শ্যালিকারা ফিতা ধরল। এরপর চলল টাকা নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা, সব সালমান
ভাই ই নিয়ন্ত্রণ করলেন। অবশেষে চারহাজার টাকায় সমঝোতা হল। আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম।
কারণ আমি যতবার শ্যালক ছিলাম, কখনো দুহাজারের বেশি গেটে দেয়নি কেউ! যাহোক ফিতা
কেটে ভেতরে ঢুকতেই বাড়িতে হৈ হৈ শুরু হল। “বর আসছে!” “বর আসছে!” আর এদিকে আমার মনের
মধ্যে সাহিত্য পাঠ শুরু হয়ে গেছে। আচ্ছা সে এখন কেমন বোধ করছে! সবাই যখন দৌড়ে এসে
বলছে “আপু তোর বর এসে গেছে!” তখন সে কি মুচকি হাসছে। নাকি আয়নায় চোখের কাজল লাগাতে
লাগাতে হালকা মুখ বাঁকা করে বলছে, “আসুক গা, আমার কি!” এসব ভাবছি আর মনের মধ্যে
রোমান্স ফিল হচ্ছে। কখন যে বাড়ির প্রায়
ভেতরে ঢুকে পড়েছি খেয়াল করিনি। শ্বশুর এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি সম্মোহিতের মত
হয়ে গেছিলাম, ফলে তিনবারের পর চতুর্থবার ও কাঁধ মিলিয়ে ফেললাম। শ্বশুর বেচারা
কিছুটা বিব্রত হয়েছে বোধহয়। যাহোক, আমাদের কে স্টেজে বসতে দেয়া হল। অনেকে এসে আমার
ছবি তুলছে। আবার কেউ কেউ কনফিউশনে পড়ে জিজ্ঞেস করছে বর কোনটা। সে এক লজ্জাকর
পরিস্থিতি। এদিকে সবাই যখন ছবি তুলছে, আমি কি এক্সপ্রেশন দিব সেটাই ঠিক করতে
পারছিলাম না। এমনিতেই আমার ছবি খুব বাজে আসে, তার উপর কোন এক্সপ্রেশন ও জানা নেই।
শেরওয়ানির সাথে খয়েরি টুপি পড়েছি, বিভীষিকা লাগছিল আমার। একটু পর “আগে বরকে বসাই
দিই” বলে শ্বশুর ওদিক থেকে চিৎকার করতে করতে আসছিল। আমি মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ
দিচ্ছিলাম। ক্ষিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। বলতেও পারছিনা। তো বেশ কিছুক্ষণ পরে
আমার ডাক পড়ল। আমি বোধহয় সবার চেয়ে বেশী উত্তেজিত ছিলাম তাই সবার আগে গিয়ে টেবিলে
বসে পড়লাম। বয় আমার জন্য প্লেট সাজিয়ে নিয়ে এল। প্লেটে একটা পুরো মোরগ থাকায়
অর্ধেক জায়গা সেটাই নিয়ে নিল, এরপর মাছ, খাসি, ডিম, চিংড়ি সব মিলিয়ে পোলাওয়ের জন্য
জায়গাই রইল না। তাও এডজাস্ট করে এক মুঠো পরিমাণ পোলাও দেয়া হল। আমি বয়কে ডেকে
বললাম, “আমার প্লেটে হাত নাড়ানোর জায়গা করে দাও, মুরগীর জন্য আলাদা প্লেট দাও”
আমার টেবিলে সবাই মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমি কোন ফর্মালিটি জানতাম না, সালমান
ভাই বলল শ্যালক দের ডেকে কিছু কিছু খাইয়ে দিতে। আমি মুরগী টা ছিঁড়ে ছিড়ে সবাইকে
কিছু কিছু দিলাম। পরে ভাবলাম ধূর! এত ফর্মালিটি ম্যান্টেন করতে গেলে শেষে নিজের
পেটই ভরবে না। এই বলে নিজে নিজেই খাওয়া শুরু করলাম। ওয়েটার রা বারবার এসে বড় বড়া
দাঁত কেলানো হাসি সমেত নিজেদের কে প্রদর্শন করে যাচ্ছে বকশিশের জন্য আর ভদ্রতার
খাতিরে জিজ্ঞেস করছে “স্যার কিছু লাগবে?” আমরাও প্রতিবার তাদের কে না করে বিদায়
করছি। খাওয়াপর্ব শেষে সবাই আবার স্টেজে গিয়ে বসলাম।
(১৮)
এবার চলে এল সেই অন্তিম মূহুর্ত! এখন
বিয়ে হবে। জীবন থেকে পঁচিশ বছর অতিক্রম করেছি এইদিন টা কবে দেখব কবে দেখব করে।
অবশেষে সেই মূহুর্ত এল। হুজুর বিভিন্ন দোয়াদরূদ পড়লেন। কিন্তু আমি তখন অন্য কথা
ভাবছি, বিয়ে তো আমার একা হচ্ছেনা, মেয়ের ও হচ্ছে, তাহলে সে এখানে নেই কেন! এসব
ভাবতে ভাবতে হুজুর পড়তেছেন আমার বাবার নাম এরপর আমার নাম এরপর কি কি জানি বললেন।
এরপর আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন এখানে তোমার সিগনেচার দাও। আমি কনফিউজড
হয়ে গেলাম কিভাবে সিগনেচার দিব এই ভেবে। আমি হুজুর কে প্রশ্ন করলাম, “হুজুর আমি তো
শুধু আমার নাম লিখি, সেটা হবে? নাকি পেঁচিয়ে সিগনেচার দিতে হবে?” হুজুর মুচকি হেসে
বললেন, “নাম লিখলেই হবে”
এরপর আমার সই করা কাগজ টা ভেতরে
পাঠানো হল, বোধহয় কনের ও সিগনেচার নেয়া হবে। কিছুক্ষণ পর হুজুর মুনাজাত ধরলেন। আমি
হা করে তাকিয়ে রইলাম। মুনাজাত শেষে আমি হুজুরের কানে কানে ফিসফিস করে বললাম,
“হুজুর! কবুল বলা লাগেনা?”
হুজুর এবার হো হো করে হেসে দিলেন।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল হুজুরের মুখটা চেপে ধরি। উপস্থিত সবাই বুঝে
নিয়েছে যে আমি আবার কোন বোকা কথা বলেছি। আমি দোয়া করছিলাম হুজুর যেন আমাকে
পার্সোনালি বলে উত্তর টা। কিন্তু না, তিনি পাব্লিক পোস্ট দিলেন। অর্থাৎ সবাইকে
শুনিয়ে বললেন, “আরে কবুল টবুল এগুলো সিনেমায় দেখায়। এখানে নাই। তুমি কনে কে বউ
হিসেবে মেনে নিয়েছো, সে তোমাকে বর হিসেবে মেনে নিয়েছে এটাই যথেষ্ট। তোমাদের বিয়ে
হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। হা হা হা” ইচ্ছে করছিল হুজুরের মুখের মধ্যে টেপ মেরে
দেই। এদিকে বাবা আমার দিকে তখন অগ্নিশর্মা হয়ে তাকিয়ে আছেন। বাবাকে আমার দিকে কখনো
স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনা। আজ এমন একটা বিয়ের দিনেও তিনি এমন ভাবে তাকাচ্ছেন
যেন সেই দৃষ্টি বলছে, “আজ বাড়ি চল, দেখাচ্ছি”
বিয়ে শেষ হয়ে গেল। এবার আমাদের মেয়ের
ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা সোফায় বসানো হল। কিছুক্ষণ পর কনেকে এনে ঐ সোফায় বসানো
হল। সবাই চারদিক থেকে ছবি তুলছে। এদিকে আমার বিরক্ত লাগছে, পরবর্তীতে এসব ছবি নিয়ে
গবেষণা হবে, ছেলের নাক এরকম, চোখ এরকম, মুখ চিপা কত রকম সমালোচনা। যাহোক কিছুক্ষণ
পর শ্বশুর আসলেন, এসে আমার সামনে বসলেন। আমি কনফিউজড হয়ে গেলাম কি করতে হবে। আমি
তাঁর সাথে হাত মিলিয়ে ফেললাম। তিনি মুচকি হাসলেন, হয়ত বুঝতে পেরেছেন আমি নার্ভাস।
এরপর তিনি আমার হাত কনের হাতে রাখলেন, আমি নীরা কে কেন এখনো নীরা বলতে পারছিনা
সত্যিই বুঝতে পারছি না। যাহোক আমাদের দুজনের হাত মিলিয়ে দিয়ে তিনি দোয়া করলেন।
এরপর আমি হাত সরিয়ে নিলাম। শ্বশুর আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন চামচের আগায় করে। আমি
এবারো সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। এরপর শ্বাশুড়ি এসে আমার সামনে বসলেন। আমি মাথা নিচু
করে রইলাম। শ্বাশুড়ি আমার হাতে একটা ছোট প্যাকেট গুঁজে দিলেন, প্যাকেটে চেইন আছে
বলে ধারণা করছি। যাক, বাবার চেইনের দুঃখ ঘুচল! মনে মনে খানিকটা হেসে নিলাম। এবং
এরপর আরো ডজনখানেক মুরুব্বী এসে আমাদের দুজনকে দোয়া করে গেলেন এবং জামাইর হাতে
গুজে দিয়ে গেলেন কিছু নোট। নিজেকে ফকির ফকির মনে হচ্ছিল। তাই এরপর একে একে
শ্যালিকারা আর শ্যালকরা আসল সালাম করতে আর তাদের হাতে একে একে নোট গুলো গুজে দিতে
লাগলাম। কিন্তু কূলিয়ে উঠতে পারলাম না। নোটের বন্যা বইছে দেখে ভেতর থেকে আরো আরো
শ্যালক-শ্যালিকা আমদানি হতে লাগল। মায়ের কোল থেকে পিচ্চিও নেমে এসে বলে আমি
দুলাভাই রে সালাম করব। আমার নোটের চালান ক্রমেই শেষ হয়ে এল। এবং এই পর্ব টা দ্রুত
শেষ করে কান্নাকাটি অর্থাৎ বিদায়ের পর্বের দিকে অগ্রসর হলাম।
(১৯)
এবার শ্বাশুড়ি আম্মা তার রোল যথার্থ
ভাবে প্লে করেছেন। ইনার থেকে মায়ের কিছু শেখা উচিত। বোনের বিয়েতে মায়ের কান্না টা
খুব একটা জমে নি। শ্বাশুড়ির কান্না টা খুব উপভোগ করলাম। সেই সাথে নীরার ও চিকন
সুরে কান্না শুনলাম। সে আওয়াজ করে কাঁদছে না, এখনো আমার সাথে কণ্ঠের পর্দা করছে
কিনা কে জানে! যাইহোক, বিয়ের পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু আমি এতটাই আহাম্মক যে
এখনো আমি বউয়ের চেহারা দেখিনি। অবশ্য সে লম্বা ঘোমটা দিয়ে রেখেছে, দেখার তেমন একটা
উপায় নেই। কিন্তু তাও অনেক চেষ্টা করলাম ওড়নার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে একটু দেখা যায়
কিনা। নিজেকে ছেঁচড়া মনে হল হঠাৎ তাই উঁকিঝুঁকি বন্ধ করলাম। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে
গিয়ে দেখি আমার গাড়িটা নেই। আরে! গাড়ি কই গেল। পরে বুঝলাম, সব ফুল পিচ্চিরা ছিঁড়ে
নিয়ে গেছে। আর কোন ফুল না থাকায় হঠাত গাড়িটাকে নগ্ন নগ্ন লাগছে, তাই চিনতে পারছি
না। গাড়িতে উঠিয়ে দেয়ার আগে শ্বশুর ও খানিকটা কান্না করলেন আর আমাকে বললেন, “আমার
মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা”
আমি তাঁর হাতে হাত রাখলাম। মনে মনে
একটা পাঞ্চ লাইন ঝাড়লাম। “এখনো তো দেখিনি, বাড়ি গিয়ে আগে দেখি, তারপর দেখে রাখবো”
এদিকে কান্নাকাটির পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে। এবার মেয়েকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে শ্বশুর
আমাকে “ফি-আমানিল্লাহ” বলে বোধহয় আমার গাড়িতে ওঠার অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে আমি
বুঝতে না পেরে হা করে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে সালমান ভাই আমাকে জোর করে ভেতরে
ঢুকিয়ে দিতে আমার খেয়াল হল। ভেতরে বসার একটু পরেই গাড়ি ছেড়ে দিল। নীরার কান্না
থেমে গেছে। কান্না করলে খুব ঘুম পায়, ওর ঘুম পেয়েছে কিনা খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু
জিনিসটা অস্বাভাবিক দেখাবে বলে চুপ মেরে বসে রইলাম। বাড়ি পৌঁছাতেই হই হই পড়ে গেল।
আসিফ বউ নিয়ে এসেছে। এই লাইন টা যখন আমার কানে আসল তখন আমার হুঁশ হল, আরে! আমি
বিয়ে করে ফেলেছি। পাশে সাজুগুজু করা মেয়েটা আমার বউ! অন্যরকম এক অনুভূতিতে মন ছেয়ে
গেল। মনের মধ্যে উদিত নারায়ণের “পেহলা নাশা” গানটা বেজে উঠল। তখনি ড্রাইভারের ফোনে
“আশিক বানায়া” রিংটোন বেজে উঠল।
-হুর মিয়া! ফোনের আওয়াজ এত বেশী কেন?
ড্রাইভার লজ্জা পেয়ে ফোন কেটে দিল।
গাড়ি থেকে নামিয়ে বউকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আর আমি বীরের মত বুক ফুলিয়ে ঘরে ঢুকলাম
যেন সদ্য এভারেস্ট জয় করে ফিরেছি। বউকে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। মা কয়েকজন মহিলা সহ
বউকে ঘিরে বসেছে, আমাকে এখন ভেতরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। এখন ক্রিটিসিজম পর্ব।
মহিলারা নানান ধরণের কথা বলবে। কেউ বলবে “মাশাআল্লাহ মেয়ে অনেক সুন্দর!” কেউ একটু
মুখ বাঁকা করে বলবে, “নাক তো মনে হয় খাড়া না” কেউ কেউ বলবে “কি ঘর থেকে আসছে, গয়না
দিয়ে শরীর না ভরলে হয়!” এই ক্রিটিসিজম সহ্য করার ক্ষমতা কারো থাকে, কারো থাকেনা।
যে সহ্য করে নেয়, সে লক্ষী বউ, যে পারেনা সে জল্লাদ!
(২০)
বাড়িতে বেশ আনন্দ হল রাতভর। বউকে
ঘিরে অনেক গান হল, অনেকে অনেক কৌতুক বলল। ওদিকে আমাদের ঘর টা সাজানো হল বেশ করে।
আমি বারবারই গিয়ে সেখানে ভেটো দিচ্ছি, “ভাই, দয়া করে ফুল দিয়ে সাজাইস না। ফুলের
গন্ধ আমার সহ্য হয়না, বমি করে দিব”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ইউটিউব থেকে
টিউটোরিয়াল দেখে সবচেয়ে জটিল আর জমকালো স্টাইলে সাজানো হল বাসর ঘর। এতসব হয়ে গেল,
এর মধ্যেও আমি আমার বউকে দেখি নি। তাকে অন্য রুমে রাখা হয়েছে, সেখানে তাকে ঘিরে
রয়েছে এ বাড়ির মেয়েরা। গল্প জুড়ে দিয়েছে নতুন ভাবির সাথে। আমাকে ঐ রুমের আশেপাশেও
ঘেষতে দেয়া হচ্ছেনা। সবাই বলছে, “সবুর!”
এখন কাকে বোঝাই, যে আমি আমার বউকে
এখনো দেখিইনি। যাহোক রাত অনেক হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া হল বেশ জম্পেশ।
অবশেষে এল সেই মূহুর্ত! সাজানো ঘর
টায় বউকে রেখে আসা হল। এরপর আমাকে এক
প্রকার ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা অতটা ফিল্মি
হবেনা। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখি ঘটনা অন্য। এই বউ বোধহয় ফিল্মের পোকা। সে ফিল্মি
স্টাইলে খাটের ঠিক মাঝবরাবর বসে আছে। ঘোমটা অনেক দূর পর্যন্ত নামানো। আমি কিভাবে
কনভারসেশন শুরু করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে ফেসবুক স্টাইলে শুরু করব বলেই
সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি বললাম “হাই”
সে নিরুত্তর। আমার মেজাজ চড়ে গেল।
সিন করে রিপ্লে না দেয়ার মানে কি, আই মিন শুনেও উত্তর না দেয়ার কি মানে। স্বামী
আমি তার, আর আজ বাসর রাত। অনেকক্ষণ পর ছোট্ট করে আওয়াজ এল “জ্বী”
সত্যিকার অর্থে সে আওয়াজ একটা সুর
ছিল। যে সুর ‘অপরিচিতা’ গল্পে অনুপম শুনেছিল ট্রেনে! আলো আধারীর মাঝে। সেই ছোট্ট
একটা বাক্য “জায়গা আছে”
আমি পুরোপুরি গল্পে ডুবে গেলাম। আর
এতটা ডুবে গেলাম যে আমি বলে ফেললাম, “কল্যাণী! জায়গা আছে?” বলেই জিভে কামড় দিলাম।
ইশ! কি বলে ফেলেছি। মনে মনে দোয়ায়ে কুনুত পড়তে লাগলাম। বিয়ের প্রথম দিনেই বউয়ের
কাছে নিজেকে পরকীয়াময় পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করে ফেললাম। কেঁপে কেঁপে বললাম, “ইয়ে!
তুমি ইন্টারে অপরিচিতা পড়েছো না?”
সে হিহি করে হেসে দিল আর আমার প্রাণে
পানি ফিরে এল। বলল, “আপনি তো আমাকে দেখেন নি। দেখতে চান না?”
আমি আনন্দে গদগদ হয়ে গেলাম। ঘোমটা
খুলেই চিৎকার দিয়ে এক ইঞ্চি সরে এলাম।
“আআআ! তুমি?”
“হিহি। চমকে গেলে তো?
“চমকাবো না মানে! সত্যি ই তুমি? নাকি
আমি স্বপ্ন দেখছি!”
“স্বপ্ন দেখছো না। সত্যিই দেখছো”
“তুমি ঐ নীরা!”
“কোন নীরা?”
“আমার নীরা!”
নীরা মুচকি হাসল। আর একবার চোখ বুঝল।
আমার চোখে পানি এসে গেল। নীরা আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল, “নয়তো, এত বোকা জামাইয়ের বউ
হওয়ার শখ হয় কারো? তুমি একটুও বদলাও নি আসিফ। স্কুলের সেই ডানপিঠে বোকা ছেলেটা
এখনো তেমন!”
জীবনে প্রথমবারের মত নিজের বোকামি
নিয়ে খুব গর্ব হল। এই বোকামি ই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আমার নীরা। যাকে খুব ছোটবেলায়
হারিয়ে ফেলেছিলাম! ভেবেছিলাম হয়ত কখনোই ফিরে পাবনা। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা কে বুঝতে
পারে! আল্লাহ ঠিক তাকে আমার করে দিয়েছে। বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে,
মানুষটা যদি পজিটিভ ফিডব্যাক না দিত তাহলে হয়ত আজ এই দিনটা দেখতাম না! আসলেই
বাবারা অনন্য।
-কি ভাবছো গো?
-ভাবছি আমি খাটের কোন পাশে শোব? ডান
পাশে শুলে নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! আর বাম পাশে শুলে ফ্যানের বাতাস
লাগেনা।
শুনে নীরার মুখ বাবার মত হয়ে গেল
অর্থাৎ রেগে গেছে। আমিও উত্তর বুঝে গেলাম। স্যাক্রিফাইস করতে হবে।
-ওকে। বাম পাশেই শুচ্ছি।
এদিকে বাইরে হৈ চৈ শুরু হয়েছে। আমার
চিৎকার বোধহয় সবাই শুনতে পেয়েছে। কি এক কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। বাসর রাতেও কেলেঙ্কারি
আমার পিছু ছাড়ল না!
(সমাপ্ত)
speechless , হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ।😆
ReplyDeleteদারুণ😂❤️
ReplyDelete