আবদুল মুত্তালিব ও তিনটি অলৌকিক ঘটনা


আবদুল মুত্তালিবের কথা আমরা সবাই জানি। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দাদা। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিনা। তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের বনু হাশেম গোত্রের গোত্রপ্রধান। কুরাইশরা তাঁকে এত বেশি সম্মান করতো, যা অন্য কাউকে কখনো করেনি। তিনি যা বলতেন, তাই গুরুত্বসহকারে দেখা হত।

শুধু কুরাইশরা নয়, মক্কাবাসীই তাঁকে প্রচণ্ড সম্মান করত। তিনি ছিলেন মক্কার একজন সেলেব্রিটি, এমনটাও বলা চলে। কিন্তু কীভাবে? কেনই বা তিনি এত বিখ্যাত ছিলেন? মূলত, তাঁর জীবনে ঘটেছিল তিনটি অলৌকিক ঘটনা। সেগুলোই তাঁকে বিখ্যাত করেছিল। আর সে ঘটনাগুলোই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়।
ঘটনাগুলোতে যাওয়ার আগে পাঠককে একটি অজানা তথ্য দেই। অনেকেই হয়ত নাও জানতে পারেন যে আবদুল মুত্তালিবের প্রকৃত নাম ছিল শায়বা। এই নামটির অর্থ হচ্ছে 'বৃদ্ধ লোক'।
এখন পাঠক ভাবতেই পারেন, যখন তিনি ছোট ছিলেন তখনই তো এই নাম দেয়া হয়েছে, তাহলে এমন অদ্ভুত নাম কেন দেয়া হল? ছোটবেলায় তাঁর মাথার পেছনে কিছু চুল ছিল ধূসর রঙের। সেজন্যই তাঁর এই নাম রাখা হয়। শায়বার বাবা হাশেম বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন আরবের বাইরে। আর সেখানেই তিনি মারা যান।
তাই শায়বার মা তাঁকে নিয়ে মদীনায় নিজের বাপের বাড়িতে চলে যান। কয়েক বছর পর শায়বার চাচা আবু মুত্তালিব মদীনায় যান শায়বাকে মক্কায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু, শায়বার মা এতে রাজি হন না। এদিকে আবু মুত্তালিব তাকে বোঝান যে, শায়বা কোরাইশ বংশের ছেলে। এই বংশের লোকজন ক্বাবা ঘরের খেদমতের দায়িত্ব পেয়ে সম্মানিত হয়েছে। তাঁর উচিত মক্কায় ফিরে যাওয়া। পরে শায়বার মা রাজি হন আর শায়বা তাঁর চাচার সঙ্গে মক্কায় চলে আসেন। এদিকে মক্কায় কেউ তাঁকে চিনতো না। আবু মুত্তালিবের সঙ্গে তাঁকে দেখে তারা মনে করল তিনি আবু মুত্তালিবের দাস।
তাই তারা তাঁকে 'আবদুল মুত্তালিব' বলে ডাকতে লাগলো। মানে হল মুত্তালিবের 'বান্দা', 'চাকর', 'দাস' প্রভৃতি। সেই থেকে তাঁর নাম আবদুল মুত্তালিব। পাঠক, এবার আমরা ঘটনাগুলোতে চলে যাব সরাসরি।
  • যমযম কূপ পুনরাবিষ্কার।
  • পুত্র আবদুল্লাহকে বলিদান।
  • আবরাহার মক্কা আক্রমণ।
যমযম কূপের পুনরাবিষ্কার:
যমযম কূপের আবিষ্কার হয়েছিল হযরত ঈসমাইল (আলাইহিসসালাম) এর জন্মের বছরে। ঘটনাটি জানা আছে সবারই। এরপর বহু বছর সেই কূপটির অস্তিত্ব ছিল। কুরাইশরা যুদ্ধ করে হস্তগত করার আগে ক্বাবার দায়িত্বে ছিল বনু যুরহাম গোত্র। পরবর্তীতে কুসাই বিন ক্বাবের নেতৃত্বে কুরাইশরা যুরহাম গোত্রকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করে। যাওয়ার সময় সেই যুরহাম গোত্র যমযমের কূপের মুখ বন্ধ করে দিয়ে যায়। এরপর বহু বছর যমযমের অবস্থান সবার অজানা ছিল! আবদুল মুত্তালিব স্বপ্নাদেশে এর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পান৷
একদিন আবদুল মুত্তালিবের কা'বার হাতীমের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন। তখন স্বপ্নে দেখলেন এক আগন্তুক এসে তাঁকে বলল, "তায়্যেবা খনন করো!", তিনি বললেন, "তায়্যেবা কী?" আগন্তুক কিছু না বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এর পরের দিন তিনি নিজের শোয়ার ঘরের ঘুমিয়ে ছিলেন। স্বপ্নে সেই আগন্তুক আবার এসে বললেন, "বাররা খনন করো!", তিনি বললেন, "বাররা কি?" আগন্তুক উত্তর না দিয়ে চলে গেল। এরপরের রাত আবারো এসে বলল, "মাযনুন খনন করো!", তিনি বললেন, "মাযনুন কি?" এবারো আগন্তুক কিছু না বলে চলে গেল। এর পরদিন এসে আগন্তুক বললেন, "যমযম খনন করো!", তিনি বললেন, "যমযম কি?" আগন্তুক বলল, "যেই কূপের পানি কখনো শুকাবে না। হাজীরা যেখান থেকে পানি পান করবেন। যেটি অবস্থিত গোবর ও রক্তের মাঝখানে। সাদা পা বিশিষ্ট কাকের নিকটে, পিঁপড়ের বসতির পাশে।"
তার পরদিন সকালে তিনি পুত্র হারিছকে সঙ্গে করে কোদাল নিয়ে যমযম খনন করতে চললেন৷ হারিছ ছিল তখন তাঁর একমাত্র পুত্র। স্বপ্নাদেশে প্রাপ্ত জায়গাটিতে খনন কাজ শুরু করলে প্রথমে কুরাইশদের কিছু লোক বাধা দেয়। এই বাধা দেয়ার কারণ হিসেবে একটি পৃথক বর্ণনা পাওয়া যায় যেটি আছে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে। সেখানে বলা আছে, আবদুল মুত্তালিব আসাফ ও নায়লা নামক মূর্তিদ্বয়ের মাঝখানে সাদা পা বিশিষ্ট কাককে ঠোকরাতে দেখে সেখানে খনন করা শুরু করেন।
কিন্তু জায়গাটি ছিল কুরাইশদের পশু বলি দেয়ার জায়গা। তাই তারা আবদুল মুত্তালিবকে খননে বাধা দেয়। তাঁকে সহায়তা করার জন্য শুধুমাত্র একজন পুত্র ছাড়া আর কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না। তখন তাঁর মনে হল তাঁর আরো পুত্র প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি মনে মনে একটি মানত করেন, সে মানতের বিষয়ে পরের ঘটনায় বলব।
যাহোক, আবদুল মুত্তালিব ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি পুত্র হারিছকে বললেন, "আমি কূপ খনন করা পর্যন্ত তুমি আমাকে হেফাজত করো।" তাঁর এই দৃঢ়তা দেখে কুরাইশরা তাঁকে বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকে। এরপর তিনি কূপ খনন করতে থাকেন এবং কিছুক্ষণ পর কূপের ঢাকনা দেখে "আল্লাহু আকবার!" বলে চিৎকার করে ওঠেন। তাঁর চিৎকার শুনে কুরাইশরা ছুটে আসে।
এসে তারা কূপটি দেখতে পায়। একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, কূপের সাথে তিনি স্বর্ণের দুটি হরিণ, তলোয়ার এবং বর্মও পেয়েছিলেন। কুরাইশরা এবার এই কূপ এবং লব্ধ সম্পদে নিজেদের মালিকানা দাবি করে বসে। তারা বলে, "এই কূপ আমাদের পিতা ঈসমাইলের কূপ, তাই এতে আমাদের অধিকার আছে।" কিন্তু,আবদুল মুত্তালিব অস্বীকার করেন। যেহেতু তিনি স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়েছেন এবং কূপটি খনক করে আবিষ্কার করেছেন, তাই তিনি মালিকানা ভাগ করতে রাজি হলেন না। পরে সেখান থেকে কেউ কেউ বলল, বিষয়টি মিমাংসার জন্য বনূ সা'দ গোত্রের গণক মহিলার কাছে যাওয়া হোক! সবাই এতে সম্মত হল।
কিন্তু সেই গণক ছিল শা'ম বা বর্তমান সিরিয়ায়। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব বনু উমাইয়া এবং কুরাইশের প্রত্যেক গোত্রের একজন করে নিয়ে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে মরুভূমিতে তাদের পানি ফুরিয়ে গেল। সবাই আসন্ন মৃত্যু দেখতে পেল। আবদুল মুত্তালিব বললেন, সবাই নিজ নিজ কবর খুঁড়ে ফেলুক! যাতে একজন মারা গেলে অন্যরা তাকে কবরে শোয়াতে পারে। এতে অন্তত একজন বাদে বাকি সবাই দাফন হবে। সবাই এতে সম্মত হয়ে কবর খুঁড়ে তাতে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আবদুল মুত্তালিব আবার বললেন, মৃত্যুর অপেক্ষা করা কোন সমাধান হতে পারে না।
তাই তিনি সবাইকে পানির খোঁজে ছড়িয়ে পড়তে বললেন। সবাই পানির খোঁজে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পানির খোঁজ পেলেন আবদুল মুত্তালিব। কোন কোন বর্ণনায় আছে, আবদুল মুত্তালিব হঠাৎ দেখতে পেলেন তাঁর উটের পায়ের নিচ থেকে পানির ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে। তিনি এবং তাঁর সাথীরা সমস্বরে 'আল্লাহু আকবার' বলে উঠলেন। তারপর তারা সবাই পানি পান করল এবং নিজেদের মশক পূর্ণ করে নিল।
এরপর বাকিরা সবাই মিলে বলল, "হে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর বিজয়ী করেছেন। তিনিই তোমাকে এই মরুভূমিতে পানি পান করিয়েছেন আর তিনিই তোমাকে যমযমের সন্ধান দিয়েছেন। তাই, এই কূপের মালিকানা তোমারই। আর আমরা এই বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে বিবাদ করব না।" এরপর তারা সবাই মক্কায় ফিরে গেলেন। তারপর থেকে যমযম কূপ হাজীদের পানি পান করার জন্য ব্যবহৃত হতে লাগলো।
আবদুল্লাহকে বলিদানের মানত:
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই মনে আছে যখন কুরাইশরা আবদুল মুত্তালিবকে কূপ খননে বাধা দিয়েছিল, তখন তাঁর মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করছিল এই ভেবে যে, কেন তাঁর একটি মাত্র পুত্র সন্তান! তাঁর আরো কয়েকটি পুত্র সন্তান হলে তিনি আরো সাহস পেতেন। তাই তিনি মানত করলেন,যদি তাঁর দশটি পুত্র সন্তান হয়, তবে তিনি একজনকে আল্লাহর জন্য বলি দেবেন। এবং এরপর তাঁর একেএকে দশটি পুত্র সন্তান হয়। যখন তিনি দেখলেন তারা বালেগ হয়েছে, তখন তিনি সবাইকে জড়ো করে তাঁর মানতের কথা জানালেন।
পুত্ররা সম্মতি জানালে তাদের মধ্যে লটারি করা হল। লটারিতে এল আবদুল মুত্তালিবের সর্বকনিষ্ঠ ও সবচাইতে প্রিয় সন্তান আবদুল্লাহর নাম। অগত্যা তিনি আবদুল্লাহকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে ছুরি নিয়ে জবাই করতে আসাফ ও নায়লা মূর্তির মাঝে নিয়ে গেলেন। জবাই করতে আবদুল্লাহকে শোয়ালে কুরাইশ নেতারা এগিয়ে এলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন আবদুল মুত্তালিব এটা কি করছেন। তিনি বললেন, তিনি মানত রক্ষায় পুত্রকে জবাই করতে যাচ্ছেন। সমবেত লোকেরা তাঁকে বাধা দিল। তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, যদি আবদুল মুত্তালিব এই কাজ করে তবে পুত্র বলি দেয়ার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তারা তাঁকে পরামর্শ দিলেন হিজাযে যেতে, যেখানে রয়েছেন এক গণক মহিলা, যার তত্ত্বাবধানে জ্বিন রয়েছে।
তিনিই এটির একটি ভাল সুরাহা দিতে পারবেন। আবদুল মুত্তালিব তাই করলেন। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে সেই মহিলা গণকের সঙ্গে দেখা করতে মদীনায় গেলেন। সেই মহিলা সবকিছু শুনে তাঁকে পরের দিন আসতে বলল।
পরের দিন গেলে মহিলা বলল, "আপনাদের মুক্তিপণের মূল্য কি?", তাঁরা বললেন, "দশটি উট।" মহিলা এরপর বলল, একপাশে দশটি উট ও অপরপাশে আবদুল্লাহকে রেখে লটারি করতে। যতবার আবদুল্লাহর নাম আসবে, ততবার উটের সংখ্যা যেন দশটি বাড়িয়ে দেয়া হয়। সবাই এই সিদ্ধান্তে সম্মত হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। এরপর তীর দিয়ে লটারি করা হয় উট এবং আবদুল্লাহর মাঝে। আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দুয়া করতে থাকেন। এদিকে বারবার তীর আবদুল্লাহর দিকে নির্দেশ করতে থাকে আর উটের সংখ্যা দশটি করে বাড়ানো হয়। এভাবে উটের সংখ্যা একশো হওয়ার পর অবশেষে তীর উটের দিকে নির্দেশ করে।
আবদুল মুত্তালিবকে জানানো হলে তিনি বলেন তিনি এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না। আবারো যেন লটারি করা হয়। এরপর আরো তিনবার করা হলে তিন বারই উটের দিকে নির্দেশ করে তীর। অবশেষে,আবদুল্লাহর প্রাণের বিনিময়ে একশোটি উট কুরবানি করার সিদ্ধান্ত হয়। বেঁচে যান আবদুল্লাহ। এরপর উটগুলো কুরবানি করে মক্কায় ঘরে ঘরে মাংস পাঠানো হয়,এমনকি শেষে পাখিদেরও খাওয়ানো হয়েছিল সে মাংস! সম্পূর্ণ খরচ বহন করেন আবদুল মুত্তালিব।
আবরাহার হস্তীবাহিনীর মক্কা আক্রমণের ঘটনাঃ
এই ঘটনাটি অনেকেই শুনে থাকবেন। পবিত্র কুরআনের সূরা ফীলে ঘটনাটি বর্ণিত আছে। এই ঘটনাটি ঘটেছিল রাসূল(স) এর জন্মের বছরেই। অনেকে এটিকে হস্তীবর্ষ বলে অভিহিত করে থাকেন। এই ঘটনাটিকে বলা চলে মক্কার সবচাইতে বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনা।
ইয়েমেন ছিল তখন আবিসিনিয়ার দখলে। আবরাহা নামে ইয়েমেনের তৎকালীন গভর্ণর মুসলমানদের ক্বাবা ঘরের অনুকরণে সানাতে কুল্লাইস নামে একটি গীর্জা তৈরি করে। ক্বাবাতে যেমন প্রচুর মানুষজন হজ্ব করতে যায়, তার ধারণা ছিল সে গীর্জাটিকেও তদ্রুপ মর্যাদাশীল করতে পারবে৷ এরপর সে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাসীকে পত্র পাঠায় এই মর্মে যে সে হজ্বকে এই গীর্জায় স্থানান্তরিত করতে চায়। এই খবর আরবদের কানে পৌঁছাতে দেরি হয় নি। আরবদের মধ্যে বনু কেনানা গোত্রের লোকদের রগচটা বলা হয়। নামের প্রতি সুবিচার করতেই এই বনু কেনানা গোত্রের একজন লোক গোপনে আবরাহার গীর্জায় পায়খানা করে আসে।
এই খবর পেয়ে আবরাহা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। সে মক্কা আক্রমণ করে ক্বাবা ধ্বংস করতে মনস্থির করে। সে ষাট হাজার সৈন্য ও তেরটি হাতি নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়। তার এই আক্রমণের খবরে কয়েকটি দল তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তার যাওয়ার পথেই৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'যূ-নফর' নামে একজন ইয়েমেনির নেতৃত্বে ইয়েমেনি ও কতিপয় আরবের একটি দল,দুটি খাসয়ামী গোত্র 'শাহরাম' ও 'নাহিস' -যাদের সঙ্গ দিয়েছিল সমমনা কয়েকটি আরবগোত্র। কিন্তু এরা কেউই সফল হয়নি,বরং আবরাহার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে বন্দী হয়েছিল। তায়েফ অতিক্রম করার সময় তায়েফবাসী আবরাহাকে সাহায্য ও পথপ্রদর্শন করার জন্য 'আবু রিগাল' নামে এক ব্যক্তিকে সঙ্গে দেয়। এটি মূলত মক্কার প্রতি তায়েফবাসীর হিংসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু 'মুগাম্মাস' নামক স্থানে পৌঁছাতেই রিগাল মারা যায়। আরববাসী এই আবু রিগালের কবরে পরবর্তীকালে পাথর নিক্ষেপ করত এবং এখনও মুগাম্মাসে লোকে পাথর নিক্ষেপ করে।
মুগাম্মাসে আবরাহা যাত্রাবিরতি দিল এবং'আসওয়াদ বিন মাকসূদ' নামে একজনকে পাঠাল মক্কায়। আসওয়াদ মক্কায় পৌঁছে আবার ফিরে আসার সময় কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের লোকদের কিছু উট এবং গবাদী পশু লুট করে নিল। এরমধ্যে আবদুল মুত্তালিবের দুশো উটও ছিল। এরপর আবরাহা একজন লোককে পাঠালো মক্কায় একটি খবর নিয়ে। লোকটি মক্কায় গিয়ে মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত লোককে খোঁজ করতে লাগলো। সবাই আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিমকে দেখিয়ে দিল। লোকটি তাকে বলল, "রাজা আবরাহা বলেছেন, তিনি মক্কার লোকদের কোন ক্ষতি করতে চান না, তিনি কেবল ক্বাবা ঘর ধ্বংস করতে এসেছেন, তাই মক্কার লোকদের পক্ষ থেকে যেন কোন বাধা না আসে।" উত্তরে আবদুল মুত্তালিব বলেন, "আল্লাহর ঘরে আক্রমণে যদি আল্লাহ বাধা না দেন, তবে আমরা বাধা দেয়া সামর্থ্য রাখি না।"
এরপর সেই লোকটি আবদুল মুত্তালিবকে সঙ্গে করে আবরাহার দরবারে হাজির হয়। আবদুল মুত্তালিবকে দেখে আবরাহা অভিভূত হয়, এবং তাঁকে অনেক সম্মানিত মনে করার দরুন সে তাঁর সঙ্গে মাটিতেই বসে পড়ে। এরপর আবদুল মুত্তালিব বলে ওঠেন তিনি তাঁর উট ফেরত নিতে এসেছেন। আবরাহা বলে, "তোমাকে দেখে আমার মনে যে সম্মানবোধ জাগ্রত হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তোমাদের বাপদাদার ধর্মকেন্দ্র কা'বা ধ্বংস করতে এসেছি অথচ তুমি এসেছো তোমার দুশো উট দাবি করতে?"
জবাবে আবদুল মুত্তালিব বললেন, "আমি উটের মালিক। আর কা'বা ঘরের মালিক আল্লাহ। তিনিই তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।"
এরপর আবরাহা আর কথা না বাড়িয়ে তাঁর উট ফেরত দিয়ে দেন। আবদুল মুত্তালিব মক্কায় ফিরে মক্কাবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেন এবং নিজে সবার শেষে মক্কা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তিনি কা'বার চৌকাঠ ধরে আল্লাহর কাছে একটি দুয়া করেছিলেন।
"আল্লাহ, একজন বান্দাও তার দলবল রক্ষা করে থাকে। অতএব, তুমি তোমার অনুগত বান্দাদের রক্ষা কর। ওদের ক্রুশ এবং বল-বিক্রম যেন তোমার শক্তির ওপর জয়যুক্ত না হয়। আমাদের কিবলাকে যদি তুমি ওদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো, তবে যা খুশি করো!"
(সীরাত ইবনে হিশাম)
এরপর তিনিও মক্কা ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন। এদিকে আবরাহার বাহিনী মক্কার দিকে এগুতে চাইলে বাঁধলো এক বিপত্তি! হাতিগুলো যেখানে ছিল, সেখানেই বসে পড়ল। তাদেরকে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে, শুঁড়ের ভেতর লাঠি ঢুকিয়ে রক্তাক্ত করেও মক্কার দিকে হাঁটানো গেল না। অথচ সিরিয়ার দিকে কিংবা ইয়েমেনের ফিরতি পথের দিকে মুখ ফেরালেই তারা সেদিকে দৌড়াতে শুরু করত। বলা হয়ে থাকে নুফায়েল বিন হাবীব নামে একজন হাতির কানের কাছে বলে দিয়েছিলেন বসে পড়তে এবং আল্লাহর ঘরের দিকে এক পাও না এগুতে।
এদিকে হাতিকে এগিয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টার মাঝেই সমুদ্রের দিক থেকে এক দল পাখি ছুটে এল। তারা প্রত্যেকে ঠোঁটে এবং দুই ডানায় মিলিয়ে তিনটি করে পাথর নিয়ে এল এবং ছুঁড়ে মারতে লাগলো আবরাহার বাহিনীর দিকে। সেই পাথরগুলো ছিল বুটের দানার আকৃতির। অথচ তাও সেই পাথর গুলোর একটির আঘাত পেতেই আবরাহার বাহিনী মারা পড়তে লাগলো। অনেকে পালিয়ে গেল।
আবরাহার গায়ে একটা নুড়ি পড়তেই সে মারা গেল। এই ঘটনাটি সূরা ফীলে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন।
সূরা ফীলের অনুবাদঃ
"তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক হস্তীবাহিনীর সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন? তিনি কি তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেননি? তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছিলেন, যারা তাদের প্রতি কঠিন কংকর নিক্ষেপ করেছিল আর এভাবে তাদেরকে চর্বিত ঘাষের ন্যায় বানিয়ে দিয়েছিলো।"
প্রিয় পাঠক, এই তিনটি ঘটনা আবদুল মুত্তালিবের সাথে সম্পর্কিত তিনটি বিখ্যাত ঘটনা। এই ঘটনাগুলো আবদুল মুত্তালিবকে দিয়েছে অপরিসীম খ্যাতি এবং সম্মানিত করেছে সমগ্র মক্কাবাসীর কাছে। কিন্তু কেন ঘটেছিল তাঁর সাথে এরূপ অলৌকিক সব ঘটনা? মূলত, এগুলো সবগুলোই ছিল রাসূল ﷺ এর আগমনের পূর্বাভাস। কেননা তিনি ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল! তাঁর আগমন এই বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই তাঁর আগমনের পূর্বে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটবে এবং সেগুলো ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলবে এটিই খুব স্বাভাবিক!

সীরাহ_সিরিজ


তথ্যসূত্রঃ
১. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।
২. সীরাত ইবনে হিশাম।
৩. আর রাহীকুল মাখতুম।
৪. Noble life of the Prophet.

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.