ক্লাসটেস্ট

#ক্লাস_টেস্ট
এক সেমিস্টার পার করার পর বেশ কিছুদিন আমাদের ঘুমিয়েই কাটে। স্কুলে পরীক্ষা যেদিন শেষ হত, সেদিন রাতে মায়ের কাছে আবদার করতাম “মা, আজ রাতে পড়ব না কেমন?” মা বলত, “আইএ, বিএ পাশ করে ফেলেছো?” তারপর আরো কিছুক্ষণ কাকুতি-মিনতি করে সেদিন রাতের পড়া মাফ পেতাম, এরপর সারারাত চিল। তখনকার চিল ও অদ্ভুত ছিল, সন্ধ্যায় চা খেয়েই বিছানায় শুয়ে যেতাম। এটা ছিল এক্সপেরিমেন্ট, অন্যদিন যখন পড়তে পড়তে মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হয়ে যায়, আজ ঠিক সেসময় শুয়ে থাকতে কেমন লাগে একটু দেখি। কিছুক্ষণ শুয়ে এরপর টিভি দেখতে বসে যেতাম। কিন্তু আশ্চর্য! সেদিন টিভিতে ভালো কোন অনুষ্ঠান চলতই না। অথচ পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে ঠিকই সব ভালো ভালো অনুষ্ঠান পড়ত, আর আমি শুধু মনে মনে বলতাম, “একবার পরীক্ষা শেষ করি” ভেবে দাঁত কটমট করতাম। টিভিতে ভালো অনুষ্ঠান না পেয়ে ঠিকই পড়ার টেবিলে চলে যেতাম আর বইগুলো উলটে পালটে দেখতাম। কখনো বা ঐ খেলাটা খেলতাম। এ খেলাটার নাম দিতে পারিনি কখনো, চোখ বন্ধ করে বইয়ের যেকোন পাতা উল্টাতাম আর মানুষ গুনতাম, যত মানুষ থাকতো-তত পয়েন্ট, আর মানুষ না থাকলে আউট। খেলেও বিরক্ত হয়ে গেলে পড়াই শুরু করতাম। আর এখন সেমিস্টার শেষ হওয়ার পরের একমাস “চিলিং মান্থ” হিসেবে কাটে। তখন কেউ পড়াশুনার কথা বললে তাকে শূলে চড়াতে ইচ্ছে করে। অবশ্য ক্লাস টপার হলে ভিন্ন কথা, ক্লাস টপারদের যথেষ্ট সম্মান করা হয়, কারণ তারা পরীক্ষার আগে নোটের যোগান দেয়। তো এই “চিলিং মান্থ” চলাকালীন ই হঠাৎই দুঃসংবাদ চলে আসে। কোন এক অতি নিয়মানুবর্তী শিক্ষক ঠিক সেমিস্টার শুরুর প্রথম দিন থেকে ক্লাস করানো শুরু করেন। ঘোষণা আসে, তিনি ক্লাস টেস্ট নিবেন। আমরা সবেমাত্র “চিলিং মান্থ” এর মজা নেয়া শুরু করেছি, কেউ কেউ “ঘুম সপ্তাহ” শেষ করে সবেমাত্র ব্রাশ হাতে নিয়েছে দাঁত মাজবে বলে, কেউ কেউ ট্যুরের টাকা উঠিয়ে সবেমাত্র সব গোছগাছ শুরু করেছে, এর মধ্যেই শিক্ষকদের অবৈতনিক গোলাম ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভের গম্ভীর ঘোষণা, “কাল ক্লাস টেস্ট”। এই ঘোষণা একশো মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসের মত মূহুর্তেই সব আনন্দ ডুবিয়ে দিল। চারদিকে শোকের মাতম, কেউ একেবারে হাউমাউ করে কাঁদছে, কেউ তড়িঘড়ি করে ফোন করছে এদিক ওদিক, এক ভয়াবহ পরিবেশ। ক্লাস টেস্টের আগের রাত, আমাদের জীবনের ভয়ংকর রাতগুলোর একটা। এই রাতে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছাত্র দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১। ক্লাস টপার, এদের কে এই রাতে খুব বেশি পড়তে দেখা যায় না। এরা আগেই এদের সব পড়া কমপ্লিট করে রাখে। এ রাতে এরা তারপরও প্রচুর হতাশা দেখায়, এদের হতাশা সামাল দিতে দিতে অন্যদের জীবনও হতাশায় পর্যবসিত হয়ে যায়। কিন্তু তারা ধারণা করতে পারেনা, তারা শুধুই মরিচিকা দেখে আপ্লুত হয়!
২। পরের ক্যাটাগরি হচ্ছে মাঝামাঝি, এরা আগে খুব কম পড়াশুনা করেছে, এ রাতে এদেরকে খুব পড়তে দেখা যায়। সারারাত পড়ে, পরের দিন গাড়িতে যেতে যেতেও পড়ে। এরা কঠোর পরিশ্রমী, এরা টপ করতে না পারলেও কাছাকাছি থাকে।
৩। এর পরের ক্যাটাগরি হচ্ছে কিছুটা ঠগ প্রকৃতির, এদের মাথায় দুটো জিনিস থাকে। নিজে যা পড়তে পারি, বাকিটা পাশের জন থেকে চালিয়ে দিবো। কিংবা মনে মনে ফন্দি থাকে, যেভাবেই হোক টপারের সাথে গিয়ে বসতে হবে। চুরি না করেও এদের মনে সারাক্ষণ চোর চোর ভাব থাকে।
৪। এরপর আরেকটা ক্যাটাগরি আছে, এরা প্রচন্ড হাইপার। এরা পরীক্ষার আগের রাতে পাগল হয়ে এদিক ওদিক ছোটে, কখনো এর কাছে, কখনো ওর কাছে। এরা বাসায় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে আর টেনশন ছড়িয়ে দেবে ভাইরাসের মত। এরা নিজের চুল তো ছিঁড়বেই, অন্যদের চুলেরও গোড়া নরম করে ছাড়বে।
৫। শেষের ক্যাটাগরি সম্বন্ধে আমাদের সবারই কিছুটা ধারণা আছে। এরা পড়াশুনা নিয়ে খুব একটা ধার ধারেনা। পরীক্ষার আগের রাতেও এদের মধ্যে তেমন একটা চিন্তার ছাপ দেখা যায় না। এরা প্রচন্ড আরাম করে বসবে, সিলিং এর তাকিয়ে গভীরভাবে কি যেন ভাববে, তারপর বলবে, “A single sheet of paper cannot decide my future”
পরীক্ষার দিন আসলেই অনেককিছু বদলে যায়। যে বেঞ্চে প্রতিদিন বেশ আয়েশ করে বসা হয়, সে বেঞ্চটাকেও মনে হয় যেন কাঁটায় ভরা। বসতে গিয়েও বারবার পশ্চাৎদেশ দেখে সতর্ক হতে হয়। পরীক্ষার দিনে পরিচিত চেহারাগুলো অপরিচিত হয়ে যায়। যে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এসে প্রচন্ড কষিয়ে আপনাকে ঘুষি মারত, সেও কেমন হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকে কোণা ধরে বসে পড়বে। আপনার প্রিয় শিক্ষক, যিনি রোজ হাসিমুখে কথা বলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে রুমে ঢোকার সময় তাঁকেও মনে হবে জমদূত। টপারদের এই দিনটা সবচেয়ে প্রিয় দিন। তারা তাদের উত্তেজনা নিবারণ করতে পারেনা যা কিছু পড়েছে তা পরীক্ষার খাতায় উগলে বের করে রেখে যাওয়ার অপেক্ষায়। আর এই দিনে তারা বেশকিছু মানুষের খুব খাতিরযত্ন পায়। যারা ভাল পড়ে আসেনি, তারা টপারদের অমিতাভ বচ্চনের নভরত্ন তেল মালিশ করে, শুধু একটু পাশে বসার জন্য। প্রেমিকার জন্য হাত কেটে ডেডিকেশন দেখানোর চরম বিরোধী ছেলেগুলো টপারদের কলিজা কেটে খাইয়ে দেয়। পরীক্ষার ঠিক আগ মূহুর্তে পরীক্ষার প্রস্তুতির চেয়ে কে কার সাথে বসবে তা নিয়ে প্রস্তুতি চলে বেশি। কোন টপারের সাথে কয়জন কে কিভাবে কোন পজিশনে বসানো হবে এ নিয়ে চলে বাকবিতন্ডা। আর এতসবের ফলাফল হয় শূন্য। কারণ টিচার ক্লাসে এসেই করে দেন শাফল। আর এতটা শাফল করেন, যতটা শাফল কার্ড খেলায়ও হয়না। ছেলেদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, “কিউকি টিচার ভি কাভি স্টুডেন্ট থা!” এতসব আলোচিত সমালোচিত ঘটনা পেরিয়ে আসে পরমক্ষণ, অর্থাৎ পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার সময়টুকুতে প্রশ্নের দিকে তাকালে মনে হয় চীনে চলে এসেছি। প্রশ্নের লেখাগুলো এত অপরিচিত লাগে! তার উপর টিচারের চোখ যেন “বাজপাখির নজর”, যে নজরে সন্দেহ প্রকাশ করলে “রাজা বাজিরাও” ও অসন্তুষ্ট হবেন। দেখাদেখিরও নূনতম সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে এই বস্তু জীবনের অসারতা ভাবা ব্যাতীত আর কিছু করার থাকেনা। সময় প্রায় শেষ হয় হয় এমন অবস্থায় ব্রেইন আলোর গতিতে কাজ করতে শুরু করে। একের পর এক অনেক কিছু মনে পড়ে যায় লিখার মত, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে” তো! ঠিক টিচার যখন খাতা নিয়ে টানাটানি করছেন, তখন “স্যার! একটা মিনিট প্লিজ” “হ্যাঁ! পুরা এক ঘন্টা বসে ছিলে, আর এই এক মিনিটেই সব লিখে ফেলবে তুমি!” টিচারকেও দোষারোপ করা যায়না, তাঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তাঁকে কে বোঝাবে এই মূহুর্তে আমার মধ্যে আইনস্টাইনের আত্মা ভর করেছে। টানাটানি তে মাইনাস মার্কিং এর ভয় দেখিয়ে শিক্ষক খাতা টেনে দিতে সক্ষম হন, আর আমরা “চলে যায়, প্রাণের পাখি চলে যায়” বলে বাপ্পারাজের মত অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। পাশেই তখন টপার ফুল আন্সার করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। তার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, “পৃথিবীতে এই বৈষম্য কেন?” এইসব বৈষম্যের একটা বিহিত হওয়া উচিত। তবে যাহোক, শত দুঃখ-কষ্ট ঐ ক্লাসরুম পর্যন্তই। ক্লাস থেকে বের হলেই আকাশে বাতাসে পরীক্ষা শেষের আমেজ! পাখির মত স্বাধীন হয়ে উড়ু উড়ু মন নিয়ে বের হয়ে যাই। দিনশেষে ভালো হোক বা খারাপ, পরীক্ষা তো শেষ হয়েছে!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.