সেকুলারিজমঃ নিরপেক্ষ নাকি একটি স্বতন্ত্র পক্ষ?

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড়ভাইয়ের বায়োতে একটি চমৎকার লাইন লেখা, ‘আমি নিরপেক্ষ নই, আমি জয় বাংলার লোক’



 এই ধরণের স্ট্রেটফরোয়ার্ড স্ট্যান্ড আমার ভালোলাগে। আসলেই এই পৃথিবীতে নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। সবাই-ই কোনো না কোনো দল বা মতের প্রতি সক্রিয় বা প্রচ্ছন্নভাবে সংবেদনশীল। নিরপেক্ষতা বা সুশীলতা হলো এক ধরণের হিপোক্রিসি। মানুষের মন সবসময়ই বায়াজড। লেখক ক্যাটি জয়েস বলেন, 

We constantly evaluate our world throughout our day. We have to; its part of human nature and its survival. However, too often evaluation becomes judgment. Judgment becomes bias. Bias leads us down the path of whatever emotion is tied to that bias, be it resentment, guilt or even joy.”

ধর্মনিরপেক্ষতাও কোনো নিরপেক্ষতা নয়। এটি মূলত স্বতন্ত্র একটি পক্ষ। অনেকেই হয়তো ভাববেন আমি ক্যাটাগরি এরর করছি। বলবেন, মানুষের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে আমি একটি স্বতন্ত্র বস্তুগত তত্ত্বকে তূলনা করছি। কিন্তু, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তত্ত্বটি কি মানুষ থেকে আসেনি? নাকি এটি মহাকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলো, সেখান থেকে খপ করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে? উত্তর সহজ, এই তত্ত্ব মানুষের মাথা থেকেই এসেছে। তাই একে ঢালাওভাবে নিরপেক্ষ বলা চলে না। এখন হয়তো বলতে পারেন, এটা কোনো প্রমাণ নয়। এক্সেপশনাল কেইস আছে, যেখানে মানুষ তূলনার মাধ্যমে নিরপেক্ষতা অর্জন করতে পারে। নিশ্চয়ই পারে, তবে সেটা তাত্ত্বিকভাবে। প্র্যাক্টিকালি সেটা সম্ভব নয়। লেখার বাকি অংশে আমি দেখাবো, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক কোনো দিক থেকেই সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা ‘নিরপেক্ষ’ নয়। 

সেকুলারিজমের সংজ্ঞা

সেকুলারিজম শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘saecularis’ থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ বৈষয়িক, অস্থায়ী, প্রাচীন। ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’ বইয়ে মাওলানা আবদুল রহিম (রহ) বলেন, ‘মানব জীবনের বিভিন্ন উপাদান ঝোঁক প্রবণতা, রসম-রেওয়াজ এবং অন্যান্য সামাজিক রূপ তথা স্বয়ং মানুষের জীবনকে কোনো ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল না করাকেই বলা হয় সেকুলারিজম।’ ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে ‘secularism’ এর ডেফিনিশনে লেখা ‘the belief that religion should not be involved with the ordinary social and political activities of a country.’ এ থেকে বোঝা যায়, সেকুলারিজম নির্দিষ্ট কোনো ধর্মবিশ্বাস লালন করে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেকুলারিজম কোনো বিশ্বাসই লালন করে না। বরং এটি একটি জাগতিক এবং বস্তুগত সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিশ্বাস করে যেটা নিজেই একটা ‘বিশ্বাস’। 

সেকুলারিজম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে। মাওলানা ইফতেখার সিফাতও তাঁর ‘হিউম্যান বিয়িং’ বইয়ে সেকুলারিজমের প্রিমিস দেখাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সেকুলারিজম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে। এই পৃথক করার অর্থ হলো ধর্মীয় নির্দেশনা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকা। ব্যক্তিগত জীবন কেবলি ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি ব্যক্তির জীবনাচারের পরিধি নিজ সত্তা পেরিয়ে সন্তান, বউ, মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তখন তা আর ব্যক্তিগত থাকেনা; সমষ্টিগত জীবন হয়ে যায়। এই সীমা অতিক্রম করলেই ব্যক্তির উপর হিউম্যান রাইটস এর বিধান প্রয়োগ শুরু হয়ে যায়।’ তিনি রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার ব্যাপারটিকে খানিকটা টেনে লম্বা করে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার অর্থ আসলে কী। এখান থেকে ‘ইন্ডিভিজুয়ালিজম’ ব্যাপারটি চলে আসে। এই ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ জীবন, এটাও একটা মতাদর্শ, একটা বিশ্বাস। 

সেকুলারিজমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্সিপাল হচ্ছে, ‘সকল ধর্ম ও মতাদর্শকে সমান চোখে দেখা ও ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেয়া’। শুনতে বেশ উপাদেয় হলেও এটি স্রেফ একটা তত্ত্ব, ইউটোপিয়ান ধারণা। ব্যবহারিক সেকুলারিজম অংশে আমরা দেখবো, কীভাবে সেকুলারিজম এই নিয়মটি নিয়মিত ভায়োলেট করে যাচ্ছে। অবশ্য সেকুলারিজমের দুটো প্রিমিস ভালো করে বুঝলে এটা বোঝা সহজ হয় যে, প্রথম প্রিমিসকে রক্ষার স্বার্থেই দ্বিতীয় প্রিমিসটা ভাঙতে হয়। 

পাশ্চাত্যের লেখকদের কাছে যাওয়া যাক। এন্ড্রু কপসনের ‘সেকুলারিজম- এ শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ বইয়ে সেকুলারিজমের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে তিনটি প্রিমিস উল্লেখ আছে। 

1. separation of religious institutions from the institutions of the state and no domination of the political sphere by religious institutions;

2. freedom of thought, conscience, and religion for all, with everyone free to change their beliefs and manifest their beliefs within the limits of public order and the rights of others;

3. no state discrimination against anyone on grounds of their religion or non-religious world view, with everyone receiving equal treatment on these grounds.

১ নং প্রিমিস খেয়াল করলে দেখবেন এখানে লেখা আছে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ডমিনেশন চলবে না’। ৩ নং প্রিমিসে লেখা আছে, ধর্মীয় ফিল্ডে রাষ্ট্রীয় ডমিনেশন চলবে না। এখানে ব্যাপারটা একটু সমস্যাজনক। ধর্মের কিছুর ‘moral rules’ আছে। আবার রাষ্ট্র চালাতে গেলেও কিছু ‘moral rules’ এর প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র যে নৈতিক নির্দেশনাগুলো ফলো করবে সেগুলো তো অবশ্যই ধর্ম থেকে মুক্ত থাকবে, সেটা প্রথম প্রিমিসেই বোঝা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ম কি রাষ্ট্রের মোরাল ডমিনেশন থেকে মুক্ত থাকবে? রাষ্ট্রের নিয়মাবলি তো সব মানুষ- ইনক্লুডিং ধার্মিক মানুষ মানতে বাধ্য, তাহলে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ম ধর্মের বিরুদ্ধে গেলেও সেটা তারা মানতে বাধ্য থাকবে? ব্যবহারিক সেকুলারিজম অংশে আমরা দেখবো, ধর্মের বাইরে গেলেও মানুষ রাষ্ট্রের নিয়ম মানতে বাধ্য। তাহলে ৩নং প্রিমিসটির সত্যতা কোথায়? তাহলে কি এই প্রিমিসটি নামেমাত্র? ডাবল স্ট্যান্ডার্ড?

সেকুলারিজমের উৎপত্তি

সেকুলারিজম ধারণাটি সর্বপ্রথম কে এনেছিলেন এই নিয়ে অসংখ্য মত আছে। কেউ কেউ বলেছেন ফেরাউন (রেমেসিস ২) নিজেই একটি স্রষ্টাবিহীন সেকুলার সোসাইটি গঠন করেছিলো খ্রিস্টের জন্মের হাজার বছর আগে। কেউ কেউ বলেন সক্রেটিস এবং তাঁর সময়কার গ্রিক দার্শনিকগণ, যারা দেব-দেবী এবং অন্যান্য ধারণার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তারা সেকুলারিজমের ধারণা এনেছেন। তবে সন্দেহ নেই সেকুলারিজম ধারণাটি এনলাইটেনমেন্ট পিরিয়ডে এসে জনপ্রিয় হয়। 

এনলাইটেনমেন্ট থিংকারদের মধ্যে জন লক, ভলটেয়ার, জেমস ম্যাডিসন, টমাস জেফারসন এরা সেকুলারিজম ধারণায় বেশ ভালো কন্ট্রিবিউট করেছেন। ধারণাটি পুরনো হলেও ‘secularism’ শব্দটি প্রথম নিয়ে আসেন জর্জ জ্যাকব হলিওক। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট পিরিয়ডে যখন চার্চের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু হয়, তখনি এই মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অবশ্য চার্চের সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচার এই মতবাদ বিস্তারের জ্বালানি যোগান দিয়েছিলো এই কথা বলা ভুল হবেনা। আর তাই ‘separate state from church’ আন্দোলনই একটা সময়ে সেকুলারিজমে ফর্ম করে। লক্ষ্যনীয় যে, এই আন্দোলনকারীরাও কিন্তু একটা ‘পক্ষ’। এই পক্ষ আন্দোলন করেছিলো চার্চের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে ছিলো ক্যাথলিকরা, যারা চেয়েছিলো রাষ্ট্র ক্ষমতা চার্চের হাতে থাকুক। তাহলে ‘separate state from church’ আন্দোলনকারী ‘পক্ষ’ কী করে নিজেদেরকে ‘নিরপেক্ষ’ দাবী করতে পারে? উত্তর হচ্ছে, পারে না এবং করেও না। আপনি পাশ্চাত্যে কাউকে দেখবেন না সেকুলারিজমকে ‘নিরপেক্ষ’ বলে দাবী করতে। কারণ, এটা স্পষ্টতই একটা পক্ষ। একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনকারী পক্ষ, যারা ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে হটাতে চেয়েছিলো। পরবর্তীতে এই সেকুলারিজমই ‘এথেইজম’, ‘লিবারেলিজম’ সহ অন্যান্য ‘পক্ষ’কে নিজের করা শুরু করে আর জন্ম দেয় তথাকথিত আধুনিকতার। 

সেকুলারিজম একটা ধর্ম

টাইটেলটি দেখতে অদ্ভুত হলেও এটা সত্যি। এতোক্ষণ আমরা বলেছি, সেকুলারিজম নিরপেক্ষ কিছু নয় বরং একটা পক্ষ। এখন বলছি, সেকুলারিজম কেবল একটা পক্ষই নয়, এটা একটা ধর্ম। 

প্রথমত, ধর্মের সংজ্ঞা কী? ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস এবং কর্মের সমষ্টি। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এবং স্রষ্টা প্রণীত আইনে জীবন পরিচালনা করাই ধর্ম। সেকুলারিজমও একটা জীবনব্যবস্থা, এটার কিছু আইন আছে, নৈতিক নিয়মাবলী আছে, ‘কী করা যাবে-কী করা যাবেনা’ অর্থাৎ বিধিনিষেধের একটা সেট আছে, ধর্মেরই মতো। 

এখন পাঠক বলতে পারেন, সেকুলারিজমে স্রষ্টা কে? উত্তর হচ্ছে, সে নিজে। ফেরাউন যেমন স্রষ্টাকে অস্বীকার করে নিজেই স্রষ্টা বনে গিয়েছিলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বা ইন্ডিভিজুয়ালিজমে যেমন ব্যক্তি তার ‘নফস’ বা চাহিদাকে নিজের খোদা বানিয়ে ফেলে, সেকুলারিজমও তেমনি অন্য সব স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে নিজেকেই নিজে খোদা বানায় এবং কিছু নিয়ম জারি করে। 

সেকুলারিজমের অনুসারীদের এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়, সেটা তার ধর্মের বিরুদ্ধে গেলেও মানতে হয়, নয়তো সেকুলারিজম (সেকুলার স্টেট) তাকে শাস্তি দেয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তির থেকে তার ঈশ্বরের আনুগত্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। তার ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়ে, ‘সেকুলারিজম’কে বসিয়ে দেয়া হয়। এগুলো আমার মুখের কথা নয়, ব্যবহারিক সেকুলারিজম অংশে আমার কথার পক্ষে আমি তথ্যপ্রমাণ দেবো। 

ব্যবহারিক সেকুলারিজম

সেকুলারিজম নিরপেক্ষ নয়, এটি একটি পক্ষ। এমনকি এটি একটি ধর্ম, এর নিজস্ব আইনকানুন আছে, বিধিনিষেধ আছে। ধর্মীয় আইনের বিপক্ষে গেলেও সেকুলার আইন মানতে হবে। না মানলে বাধ্য করা হবে। অর্থাৎ, ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাপারটি ভুয়া। 

জনপ্রিয় লেখক আসিফ আদনান তাঁর চিন্তাপরাধ বইয়ে ‘পূজারী ও পূজিত’ অধ্যায়ে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। 

স্কুলে কিশোর-কিশোরী একসাথে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক ক্লাসে নিজেদের ১২ ও ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তুর্কী বংশোদ্ভূত সুইস নাগরিক বাবা-মাকে প্রায় ষোল’শ পাউণ্ড জরিমানা করে সুইজারল্যান্ডের স্কুল। তারা দাবি করে সাঁতার শেখা স্কুলের কারিকুলামের অংশ, তাই ক্লাসে না পাঠানোর এখতিয়ার অভিভাবকের নেই। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই দম্পতি ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস এ মামলা করলে আদালত সুইস স্কুলের পক্ষেই রায় দেয়। ২০১৬ তে জার্মান আদালতেরও এক রায়ে বলা হয়, মুসলিম কিশোরীরা ছেলেদের সাথে সাঁতারের ক্লাস করতে বাধ্য। ২০১৬ তেই এক সুইস মুসলিম পরিবারকে ৫০০০ সুইস ফ্র্যাঙ্ক জরিমানা করা হয় তাদের ১৪ ও ১৫ বছর বয়সী দুই ছেলে স্কুলের মহিলা শিক্ষিকার সাথে হাত মেলাতে রাজি হয়নি বলে। ইউরোপের ৭ টি সহ মোট ১৩ টি দেশে নিক্বাব নিষিদ্ধ। (চিন্তাপরাধ, পৃ-৫১)

এরকম ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটেছে। উদয়ন স্কুলে ছাত্রী ফুল হাতা জামা পরায় তার হাতা কেটে দেয়া হয়েছিলো। ক’দিন আগে ঢাবি শিক্ষক ‘স্লামালেকুম’ না বলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলাকে জঙ্গিবাদের চিহ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই ঘটনাগুলো খুবই পপুলার বলে আমি রেফারেন্স উল্লেখ করলাম না। 

ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনাগুলো সেকুলার স্টেটেই ঘটছে। সুইজারল্যান্ডের ঘটনাটিই খেয়াল করুন। ধর্মীয়ভাবে ছেলে-মেয়ের একসঙ্গে সাঁতার কাটা ইসলামে বৈধ নয়। কিন্তু সেকুলার স্টেট ইসলাম ধর্মে অবৈধ কাজটিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে বৈধ করেছে। এটা কি সরাসরি ৩নং প্রিমিসটির বিরোধী কাজ হলো না? নিক্বাবের স্বাধীনতা হরন কিংবা হ্যান্ডশেক না করায় জরিমানা, এই সবই তো ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তবে কি সেকুলার আইন ইউটোপিয়ান? অর্থাৎ, এর প্রকৃত বাস্তবায়ন নেই, ব্যাপারটা কি এমন? আসলে ব্যাপারটা এমন না। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার যেই প্রিমিসটি, আসলে সেটি সম্পূর্ণই ‘লোক দেখানো’। এই প্রিমিস বাস্তবায়নের কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। কেননা তারা তো আদতে নিরপেক্ষ নয়, তারা হচ্ছে একটা পক্ষ। অতীতের চার্চবিরোধী পক্ষ আজ ‘ধর্মবিরোধী পক্ষ’। এটাই বাস্তবতা এবং এটাই সত্য। 

ইসলামী দৃষ্টিকোণ 

এই বিষয়ে মাওলানা ইফতেখার সিফাত তাঁর হিউম্যান বিয়িংঃ শতাব্দীর বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব বইয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন স্কলারের বরাত দিয়ে লিখেছেন, সেকুলারিজম একটি কুফুরী জীবনব্যবস্থা। যে সেকুলারিজমকে মেনে নেবে, সে কুফুরী করবে। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, 

‘আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন হলো ইসলাম’। (সূরা আল ইমরানঃ ১৯) 

আর, সেকুলারিজম হলো মানবসৃষ্ট দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা। ইসলামের জায়গায় অন্য কোনো জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উবুদিয়্যাত ও হাকিমিয়্যাতিকে অস্বীকার করা। আর এটা হলো কুফর ও শির্ক। সূরা মায়িদার ৫০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, 

“তারা কি জাহিলিয়্যাতের শাসনব্যবস্থা কামনা করে? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য শাসন-পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর চেয়ে উত্তম আর কে আছে?” 

মাওলানা ইফতেখার সিফাত তাঁর বইয়ের ১১৪-১১৬ পেজে সেকুলারিজমকে একটি কুফুরী মতবাদ হিসেবে দলীল দিয়ে প্রমাণ করেছেন। 

কেন?

এই কুফুরী মতবাদ আমরা কেন গ্রহণ করেছি আমাদের দেশে? অনেকেই বলবেন, আমাদের দেশ স্বাধীন করেছে সব ধর্মের মানুষ মিলে। তাদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই আমরা সেকুলারিজম গ্রহণ করেছি। যেসব মুসলিম ভাইবোনেরা এই কথা বলেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তবে কি আপনি মনে করেন ইসলাম ভিন্ন ধর্মালম্বীদের প্রাপ্য অধিকার দেয় না? 

এই কথার পরপরই আপনারা ইউটার্ন নেবেন। বলবেন, আমাদের কাছে অবশ্যই ইসলাম বেস্ট। কিন্তু, অন্য ধর্মালম্বীরা কি মানবে? তারা তো ভাববে তারা বৈষম্যের স্বীকার। এক্ষেত্রে আমি বলবো, ১০% বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে, তা আপনার কাছে দুঃখজনক (যদিও এই বৈষম্য তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে), কিন্তু এখন যে ৯০% মানুষ বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে- তাদের আকাঙ্খিত ইসলামী শাসন পাচ্ছেনা, সেটা আপনার কাছে গুরুত্ববহ নয়? 

এবার হয়তো বলবেন, সবাই কি ইসলামী শাসন চায়? চায়না, কারণ তারা পাপাচারে লিপ্ত। কেন পাপাচারে লিপ্ত? কারণ ইসলামী শাসন নেই। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে সার্কুলার আর্গুমেন্ট মনে হলেও এটা লিনিয়ার হওয়া সম্ভব যদি ইসলামী শাসন ইনপুট দেয়া যায়। এখন বলতে পারেন, কেন ইসলামী শাসন ইনপুট দিতে হবে? উত্তর সহজ- এটা আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর হুকুম হচ্ছে তাঁর জমিনে তাঁর দ্বীন কায়েম করতে হবে। এবার আপনি ঠিক করুন, আপনি কি আল্লাহর দ্বীন কায়েমে কাজ করবেন? নাকি কুফুরী দ্বীন পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবেন? 

উপসংহার

সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হোক কিংবা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, সেকুলারিজম একটি ‘পক্ষ’, একটি স্বতন্ত্র ধর্ম। এই ধর্মের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, সেগুলো মানবসৃষ্ট কিংবা কিছুক্ষেত্রে কোনো ধর্ম থেকে চুরি করা। যেমনই হোক, সেই নিয়মকানুন মানতে সেকুলার স্টেটের নাগরিক বাধ্য। না মানলে মুখোমুখি হতে হবে শাস্তির। তাহলে কেন এই ‘নিরপেক্ষ’ নামধারণ? কেন এই ডাবল স্ট্যান্ডবাজি? ভাবনার দুয়ার যদি খুলে না যায়, তবে আপনার জন্য কুফুরির এই কারাগারই উপযুক্ত। 


Post a Comment

5 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. চমৎকার উপস্থাপন ভাই, জাযাকাল্লাহ !!

    ReplyDelete
  2. আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো একটা ধারণা পেলাম।

    ReplyDelete