গতকাল একটা ছেলে মারা গেলো আত্মহত্যা করে। ছেলেটার নাম ইমাম। প্রেমসংক্রান্ত ডিপ্রেশনে ভুগে সে আত্মহত্যা করেছে। তার প্রোফাইল ঘুরে এলাম। মনে পড়ে গেলো দু'হাজার সতেরো সালের আমির কথা।
সেভায়ার ডিপ্রেশন যাকে বলে, তাতে ভুগছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার চলছে তখন। আমার প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট আমার ডিপ্রেশনকালীন সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। সেই সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুরাও বোধহয় টুকটাক জানে। সেই সময়টা এমন ছিলো যে, প্রতিটি মূহুর্তই তিক্ত মনে হতো। পুরো পৃথিবীকে মনে হতো অর্থহীন। বারবার একটা জিনিস মাথায় আসতো, মরে গেলে দাম পাবো তো? এই ভাবনাটিই সুইসাইডের পটেনশিয়াল।
বেশিরভাগ সুইসাইড করা মানুষ সুইসাইডের আগে ডিপ্রেশনের সময়টুকুতে এটাই ভাবে। যদি প্রেমিকার প্রতি ক্ষোভ থাকে, তবে ভাবে আমি মরে গেলে সে নিশ্চয়ই বুঝবে, কষ্ট পাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিবারের প্রতি ক্ষোভ থাকলে ভাবে মরে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের আজীবনের জন্য অপরাধী করে যাবো। আরো কতোকি চিন্তা থেকে মানুষ সুইসাইড করে!
এই সময়টা জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। জীবন যেকোনো দিকে চলে যেতে পারে, একেবারে যেকোনো দিকে। এখান থেকে একটা মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। এটা হচ্ছে worst case. এর থেকে better case হলো সে অন্ধকার জগতে ডুবে যেতে পারে। নারী, মাদক, অপরাধ এসবে জড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু, একটি best case ও আছে। এবং আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমার সাথে best case-টিই ঘটেছিলো।
কতো কী না করেছিলাম ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য। কিন্তু সবই নেগেটিভ কাজ। আর নেগেটিভ কাজ থেকে কখনোই পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আসে না। এটা আমার জীবনে এপ্লাই করে পাওয়া সত্য, কোন হাইপোথিসিস নয়। আর এই জায়গায়ই ভুলটি সবাই করে থাকে।
ধরুন কেউ খুব দুঃখে আছে, সে ভাবে কানে হেডফোন গুঁজে দুঃখের গান শুনলে বুঝি বেশ ভালো লাগবে! কিন্তু না, এটি তার দুঃখবোধে কাটা ঘায়ে নুনের চিটার মতো কাজ করে, বেদনাকে উস্কে দেয় উল্টো! কেউ ভাবে হারানো প্রেমিকার দুঃখ ভুলতে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলে বোধহয় আমি সুখ পাবো। এটা আরো বড়ো ভুল, কেননা এসব কেসে আপনি হারিয়ে যাওয়া মানুষকেই নতুন মানুষের মধ্যে খুঁজতে থাকেন, ফলে হীতে বিপরীতই হয় (জেনারেল দৃষ্টিকোণ থেলেই বলছি)।
কেউ ভাবে সিগারেট, মদ, গাঁজা খেলে বোধহয় দুঃখ ভোলা যাবে, কিন্তু না, এগুলো সাময়িক রিলিফ, পার্মানেন্ট কিছু নয়! এগুলো আপনার পুরনো ক্ষত তো দূর করবেই না, উল্টো একটা নতুন নেশা গছিয়ে দেবে। তাই বলছি, একটা নেগেটিভ মেমোরি ইরেজ করতে আরো নেগেটিভ কাজ করা বোকামো ছাড়া কিছু নয়।
সূরা আল ইনশিরাহয় আছে, "নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে!" আর এটা আমি আমার জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রমাণ পেয়েছি। তাই আল্লাহ আমাকে কষ্টের পর স্বস্তি দিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে? কোনো নেগেটিভ ওয়েতে? একদমই না!
আমি ডিপ্রেশন কাটাতে ব্যর্থ হয়ে চাওয়া শুরু করেছিলাম বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে। আপনাকে জায়গা বুঝতে হবে, আপনাকে বুঝতে হবে কোথায় গেলে আপনি কাঙখিত জিনিসটি পাবেন। আপনি যেমন মুদি দোকানে গিয়ে হীরের গয়না খুঁজলে পাবেন না, তেমনি সুখ দেয়ার ক্ষমতা নেই এমন কারো কাছে, এমন কিছুর কাছে, সুখ খুঁজলে হতাশ হবেন। আমি শেষমেশ সুখ খুঁজেছিলাম তাঁর কাছে, যিনি সুখের মালিক।
আমি মাসজিদে যাওয়া শুরু করলাম। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতে আদায় করতাম। আর কিছুই করতাম না, একেবারে কিছুই না। শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতে আদায় করতাম৷ ওয়াল্লাহি, এই কাজটুকুই আমাকে স্বস্তি দিয়েছিলো, সুখের সন্ধান দিয়েছিলো। এরপর থেকে টুকটাক প্র্যাক্টিস করা শুরু করেছিলাম, দাঁড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম, গান শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
যদিও মাঝখানে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় আমার সবকিছু আবার উল্টেপাল্টে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমি রিকভার করার চেষ্টা করছি। ব্যাপার হচ্ছে, আপনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট একদিনে হয়ে যাবেন না, কিন্তু ক্রমাগত চেষ্টার ওপর থাকবেন। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
বলছিলাম ডিপ্রেশন কাটানোর কথা। সেই সময়টুকু, সেই দু'হাজার আঠারো সাল পুরোটা আমার এতো ভালো কেটেছে, আলহামদুলিল্লাহ! কারণ, আমি প্রতি মূহুর্তে আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করতাম। নিজেকে হারাম থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। দৃষ্টি সংযত করতাম। ভালো কথা বলার চেষ্টা করতাম, গালাগালি করতাম না। সুগন্ধি মাখতাম। এতো সুন্দর সময় ছিলো, এতো পবিত্র সময় ছিলো! ডিপ্রেশন আমাকে ছুঁতে পর্যন্ত পারে নি!
এটা সুস্পষ্ট আল্লাহর রহমত, এখানে অন্য কিছু নেই। এবং এটাই কিউর। পৃথিবীর সকল ডিপ্রেশন, সেটা যতো সেভায়ার হোক, রিকভারি হচ্ছে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া। আর এটার আরো বড়ো প্রমাণ হচ্ছে ঊনিশ সালের মাঝামাঝি থেকে আমার আবারো দ্বীন থেকে সরে যাওয়া আর ডিপ্রেশন পেয়ে বসা। আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি, আমি যখন ক্রমাগত দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছিলাম, আমার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমি যখন দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছিলাম, আমার হৃদয়ের প্রশান্তি হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমি যখন দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছিলাম, আমি শূন্যতায় ভরে উঠছিলাম। আমাকে আবার গ্রাস করছিলো ভয়াবহ সেই ব্যধি..
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জীবিত ইমামদেরকে বলবো কিছু কথা। আপনি ডিপ্রেশনে আছেন? নিয়মিত জামায়াতে সালাত আদায় করুন, হারাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করুন, কুর'আন পড়ুন, দ্বীন সম্পর্কে পড়াশোনা করুন, দাঁড়ি ছেড়ে দিন। ওয়াল্লাহি, আপনার ডিপ্রেশন কেটে যাবে। ওয়াল্লাহি, আপনার ডিপ্রেশন চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যদি এগুলো করার পর আপনার মনে হয় আপনার ডিপ্রেশন কাটেনি, তবে আপনি আমাকে লানত দিতে পারেন।
কিন্তু প্রিয় ভাই, একটিবার চেষ্টা করে দেখুন। কতোকিছুই তো মানুষ করে ডিপ্রেশন কাটাতে! কাউন্সেলিং করে, সাইক্রিয়াটিস্ট দেখায়, ইয়োগা করে, কিংবা খারাপ পথে গেলে নারী নিয়ে, মাদক নিয়ে ডোবে। এতোকিছু করতে পারলে আপনার ভাইয়ের বলে দেয়া এই পথটিও একবার চেষ্টা করে দেখুন! ওয়াল্লাহি, আপনি ফল পাবেন। কারণ আল্লাহর ওয়াদা, তিনি আপনাকে নিরাশ করবেন না। সেই ওয়াদার আয়াতটি দিয়ে শেষ করছি..
"আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চয়ই কাফের সম্প্রদায় ব্যতিত কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।"
-সূরা ইউসুফঃ ৮৭