আত্মহত্যা ও আমার ভাবনা (৩)

 আত্মহত্যা করার আগে ফেসবুকে পোস্ট করে যাওয়া একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়ে গেছে। আজ তো দেখলাম একজন ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছে। এদের সাইকোলজি কী থাকে আমি জানিনা। তবে আমার ধারণা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাওয়া, তাদের ইচ্ছাগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে।

শোনো তবে, কিচ্ছুটি যায় আসেনা তোমার আত্মহত্যায় কারো। হ্যাঁ, কিচ্ছুটি যায় আসেনা। দুয়েকদিন তুমি ফেসবুকে ভাইরাল থাকো, কেউ কেউ দুঃখ করে, কেউ গালাগাল করে, কেউ নীতিবাক্য লেখে, শেষ! এই দুইদিনের হাইপ.. এরপর সব শেষ।
কোনো মেয়ের জন্য আত্মহত্যা করছো? কেন? সে ক'দিন দুঃখ করবে তোমার জন্য? তার স্বামী-সংসার হবে, সেগুলোতে মনোযোগ দেবে। হয়তো কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তোমার কথা এক ন্যানোসেকেন্ডের জন্য মনে পড়তেও পারে, কিন্তু সেটাও স্থায়ী হবেনা, চাপা পড়ে যাবে তার শ্বশুরের 'চা করে দাও' আবদারের নিচে। তাহলে কেন? এই ন্যানোসেকেন্ডের মনে পড়া তোমার জীবনের মূল্য?
পরিবারের ওপর রাগ করে আত্মহত্যা করছো? হয়তো একটু মন কষাকষি হয়েছে, একটু রেগে গিয়ে কটু কথা বলেছে, গায়ে হাত তুলেছে, এই তো অভিযোগ? এটুকুর জন্য তাদেরকে আজীবনের জন্য নিঃস্ব করে যাবে? ভুলে যাবে তারা কীভাবে তোমাকে বড়ো করেছেন, কীভাবে তোমার মা শরীরের সব ক'টা হাড় ভাঙার মতো যন্ত্রণা সহ্য করে তোমাকে জন্ম দিয়েছেন! কীভাবে তোমার বাবা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তোমার স্কুলের ফিস জুগিয়েছেন, ঈদের পর ঈদ কেটে গেলেও একটি শার্ট কেনেননি। অসুস্থ হলে রাতের পর রাত জেগেছেন যাঁরা, তাদের সব অবদান-ভালোবাসা-স্নেহ ভুলে যাবে?
তোমার আত্মহত্যা তোমার পরিবারকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে ভাবতে পারো? তোমাকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাবে। তোমার মৃত্যুর দায় নেয়ানেয়িতে কলহ হবে সদা। তোমার মা শোকে পাথর হয়ে যাবেন। তোমাদের ঘর হয়ে যাবে একটা জীবন্ত কবর। কোনো সুখের অনুষ্ঠানেও তোমার স্মৃতি উচ্ছ্বলতা কেড়ে নেবে। তোমার থাকার ঘর হবে সবার জন্য একটা অশুভ ঘর, তুমি হবে অশুভ মানুষ। (প্রচলিত অর্থে)
তবে কী লাভ? কী লাভ নিজেকে শেষ করে দিয়ে? এই পার্থিব জীবনেও তো তোমার আত্মহত্যার কোনো আউটকাম নেই। আর পরকালের আউটকাম তো তুমি জানোই!
চাকরি হচ্ছেনা? শুধু এটুকুই? রিযিক নিয়ে কেন এতো হতাশা? যেই লোকটা হেঁটে হেঁটে বাদাম বিক্রি করছে, যেই লোকটা সারাদিন হেঁটে হেঁটে বাচ্চাদের বই বিক্রি করছে- অথচ সারাদিনে কয়েক কপিও বিক্রি হচ্ছেনা, তার কি রিযিকের ব্যবস্থা হচ্ছেনা? কেন হতাশ হচ্ছো? কিছু না কিছু তো হবেই৷ বড়ো চাকরি হচ্ছেনা, ছোটো চাকরি করো! আত্মীয়স্বজন-পাড়াপড়শির খোঁচা এইতো? তাদের কথায় আদৌ কি কিছু আসে যায়? তারা তো তুমি সফল হলেও খুশি হবেনা।
রেজাল্ট খারাপ হয়েছে? সামনে কি আর ভালো করার সুযোগ নেই? এই রেজাল্টকে অর্থহীন প্রমাণ করে দিতে পারে হয়তো সামনের ভালো রেজাল্ট, পারে না? এসএসসির দুঃখ তুমি এইচএসসিতে ঘুচিয়ে নাও। এইচএসসির দুঃখ এডমিশনে, ভার্সিটির দুঃখ চাকরিতে। ইহজীবনের দুঃখ পরজীবনে৷
দুঃখ কতোটা আপেক্ষিক ভাবতে পারো? তোমার কাছে যা দুঃখ, তা তো কারো কাছে সুখও হতে পারে। তাহলে কেন এতো হতাশ? ঐ কবিতাটা মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের? 'একদা ছিলোনা জুতা চরণযুগলে..', দুঃখ কতোটা আপেক্ষিক ভেবেছো? দুঃখের পর স্বস্তি আছে.. অন্ধকার টানেল পেরিয়ে আলো আছে.. এগুলো হলো আশা। মানুষ আশায় বাঁচে। তলানীতে পড়ে থাকা বহু মানুষ নিজেদেরকে নিয়ে গেছে সর্বোচ্চ উচ্চতায়। যদি মরে যেতো, তবে তো বিস্মৃত হয়ে যেতো। মরেনি বলেই ইতিহাস তাদের মনে রেখেছে..
খুব হতাশ? খুব ডিপ্রেসড? কিছু করো। ভালো লাগার মতো কিছু। নিজেকে ব্যস্ত রাখো। টিপিকাল কাজগুলো নয়- দুঃখের গান, সিগারেট, অন্ধকার রুম, এসব নয়, একদম নয়। হতাশার দিনে হতাশাকে আপন করোনা। হতাশাকে ভাবতে হবে শত্রু। হতাশাকে যারা আপন করে নেয়, তারা তলিয়ে যায়। একাকীত্ব সবসময় ভালো নয়, যদি একাকীত্ব তোমার জীবন গড়তে উপযোগী হয়, তবে একা হও নয়তো না। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাও, আলোতে থাকো খুব বেশি, রোদে ঘুরে বেড়াও, পুকুরে সাঁতরাও, ঘাসে শুয়ে থাকো।
নিজেকে খুঁজে নাও। পছন্দের কাজগুলো করো।আঁকাআঁকি, লেখালিখি, বই পড়া, কতোকিছুই তো মানুষের পছন্দ! করো, কিছু না কিছু করো। নিজের কষ্টের কথা বাবা-মাকে বলো। একেবারে সঙ্কোচ নয়, তাদের কোলে মাথা রেখে বলে ফেলো তোমার কোথায় দুঃখ, কোথায় কষ্ট। হতে পারে, তাঁদের একটি বাক্যেও সমাধান আছে, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ায় সমাধান আছে, একটু মুচকি হাসিতেও সমাধান আছে।
বাবা-মায়েরা, আপনারা আপনাদের সন্তানদের দেখে রাখুন। শারিরিক স্বাস্থ্যের যেভাবে যত্ন নেন, সেভাবে মানসিক স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিন। তারা ডিপ্রেশনে আছে কী-না আপনারা হয়তো দেখেই বুঝতে পারেন, সঙ্কোচে তাদের কাছে যাওয়া হয়না, জিজ্ঞেস করা হয়না। কিন্তু প্লিজ, সঙ্কোচের চেয়ে জীবন বড়ো। সঙ্কোচ না করে তাদের মনের অবস্থা জানতে চান, সমাধান দিন।
আমার মনে পড়ে, আমি যখন খুব ডিপ্রেসড ছিলাম, আমার আম্মু আমার পাশে এসে বসে বলেছিলেন, "তোর কী হয়েছে আমাদেরকে বল, বাবা-মায়ের চেয়ে আপন কে আছে, আমাদেরকে না বললে কাকে বলবি?" এই কথাগুলো ওষুধের মতো কাজ করেছিলো। মূহুর্তের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম তাঁদের চেয়ে সত্যিই আপন আর কেউ নেই। খুব বেশি সময় লাগেনি আমার রিকোভারিতে।
তোমরা যারা আত্মহত্যা করতে চাও, এতোক্ষণ তোমাদের যা পরামর্শ দিলাম, এইসবই সাময়িক। এইসবই ঠুনকো। কীসে প্রশান্তি আছে জানো? ভালো থাকার সিক্রেট কি জানো? আল্লাহর সান্নিধ্য। অনেকেই বিরক্ত হতে পারো, কিন্তু এটাই সত্যি। যিনি আমাদের মনের মালিক, তিনি আমাদের মনের প্রশান্তিরও মালিক। তাই তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হবে। কোনো ধার্মিক মানুষকে আত্মহত্যা করতে দেখেছো? দেখবেনা, কারণ তাঁরা হৃদয়ে একটা প্রশান্তি অনুভব করে। এই প্রশান্তি আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই পাওয়া যায়।
নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্ব শুরু করলে তবেই হৃদয় প্রশান্ত হবে।
আমার কথায় বিশ্বাস করার দরকার নেই। তুমি নিজেই চেষ্টা করো। সালাতে দাঁড়াও, আল্লাহর কাছে চাও। তোমার দুঃখগুলো তাঁকে বলো। এই এক্সপেরিমেন্ট কন্টিনিউ করো একনিষ্ঠতা ও দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে। ফলাফল হাতেনাতে পেয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ। অন্তরসমূহের মালিক তোমাদের অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরে দিন এই দু'আ রাখি।
আর কেউ প্লিজ সুইসাইড করা ব্যক্তিদের পোস্ট, ভিডিও ভাইরাল করবেন না। আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এগুলোর ইমপ্যাক্ট আছে। সুইসাইডকে প্রমোট করবেন না। বেঁচে থাকাকে প্রমোট করুন, সুখ প্রমোট করুন, অন্তরের প্রশান্তিকে প্রমোট করুন। আর সচেতন থাকবেন। আপনার বন্ধুমহলে কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তার খোঁজখবর নিন, দেখা করুন, আড্ডা দিন, গল্প করুন। তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলুন।
আর হ্যাঁ, সেসব স্বার্থবাজ ইন্ডাস্ট্রিকে বলছি। মানুষের হতাশাকে পুঁজি করে ব্যবসা করা বন্ধ করুন। কষ্টের গান, সুইসাইড প্রমোটিং ফিল্ম এসব করে যারা টাকা কামাচ্ছেন, আপনারা শুধরে যান। একটা ডিপ্রেসড প্রজন্ম তৈরি করছেন আপনারা।
দ্বীনি কমিউনিটির প্রতি আহবান থাকবে এন্টি সুইসাইডাল, এন্টি ডিপ্রেশন কাজ বাড়িয়ে দিন। অসুস্থ প্রজন্মকে সুস্থ করার চেষ্টা করুন৷ অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রজন্মকে আলোর দিকে নিয়ে আসুন। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.