সুইসাইড আর না!

সুইসাইডের কেইসগুলো দেখলে আমি ভীষণ আঘাত পাই! মূহুর্তের মধ্যে নিজের জীবনের বিভীষিকাময় কিছু সময়ের কথা স্মরণ হয়। আজও একটা ছেলে সুইসাইড করেছে খবর দেখলাম। ফেসবুকে তার লম্বা সুইসাইড নোট লিখেছে, পুরোটা পড়িনি। যতোখানি বুঝলাম, প্রেমসংক্রান্ত বিষয়। 


বাকিদের কাছে সুইসাইডের কেইসটা যতোটা হাস্যকর বা দূরবর্তী মনে হয়, আমার কাছে ততোটা না। আমি ক্লিনিকাল পেশেন্ট দেখেছি। আমার নিজেরও মাঝেমাঝে এই বাজে চিন্তা এসেছে। যখন সেভিয়ার ডিপ্রেশন জেঁকে বসে, তখনই এসব হয়। অনেকেই অনেককিছু সাজেস্ট করে, বন্ধুদের পাশে থাকতে বলে।


কিন্তু আসলে কী জানেন, ডিপ্রেশনের সময় লোকসঙ্গ ভাল্লাগে না। একা থাকতে ইচ্ছে হয়। স্মৃতিময় গান শুনতে, স্মৃতিময় জায়গায় যেতে, স্মৃতিময় ঘটনা মনে করে দুঃখকে আরো উস্কে দিতে ইচ্ছে হয়। এট ফার্স্ট, ইটস ফান। ঘা চুলকানোর মতো, শুরুতে ভাল্লাগে, কিন্তু একটু পরই জ্বলুনটা শুরু হয়। কারো ভালো কথা শুনতে ইচ্ছে করে না, খেতে-ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। বদ্ধ ঘরকে বন্ধু মনে হয়। অন্ধকারকে প্রিয় লাগে, গানের লিরিক্সকে মনে হয় জীবনের অর্থ। প্রিয় সিনেমার সুইসাইডাল মোমেন্টকে মনে হয় একটা অর্থবহ ঘটনা। একটা ল্যান্ডমার্ক, একটা দৃষ্টান্ত। এটা ঘটাতে পারলেই আমি সফল, ওখানে পৌঁছাতে পারলেই সব কষ্ট শেষ! অথচ এ যেন, চুলার আগুনে পুড়ে যাওয়া হাতের যন্ত্রণা ভুলতে গিয়ে পুরো শরীরেই আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। অথচ, আমার তো এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার ছিলো, তাই না? 


জীবন কি এতোটা সস্তা? পৃথিবীর বাকিসব কিছুর চেয়ে সুপিরিয়র করে আল্লাহ আমাদেরকে বানিয়েছেন। এতো কমপ্লেক্স আমাদের শরীরের ডিজাইন যে, এটা নিয়ে টানা কয়েক বছর পড়াশোনাই করতে হয় বুঝতে গেলে। 


চোখ বুজে ফেলা কি এতোই সহজ সিদ্ধান্ত? এখনো কতো শহর-নগরে সূর্যোদয় দেখা হলো না! এখনো কতোশতো বই পড়া হলো না! এখনো নিজের কৃতিত্বের গুণে মায়ের হাসিমুখ দেখা হলো না! 


পৃথিবীর মায়া কাটানো কি এতোটাই সহজ? আরে, যেই চড়ুইটা রোজ এসে একবার করে বারান্দায় বসতো, তার প্রতিও মায়া পড়ে গেছে! যাচ্ছেতাই মেসটা ছাড়তে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আই হেইট স্কুল/কলেজ লাইফ বলে ছেড়ে আসার পর বুক ভারী হয়ে গিয়েছে। এগুলো তো আমাদের জীবনের কতো তুচ্ছ অংশ! নিজের অস্তিত্বের মায়া, পৃথিবী দেখতে পারার মায়া, মায়ের আদরমাখা ডাকের মায়া, বাবার খেয়াল রাখা চাহনির মায়া, ভাই-বোনের খুনসুটি এসব মায়া কাটানো এতটা সহজ? 


আরে বুঝলাম আরকি, সেই মেয়ের প্রতি তোমার প্রচুর আবেগ। বুঝলাম, তুমি তার স্মৃতি ভুলতে পারছোই না। কিন্তু মরে গিয়ে লাভ? এখন বলবে, লাভ-ক্ষতি কে ভাবে? আরে, কে ভাবেনা তাই বলো? তুমিও তো মৃত্যুকে একটা আউটকাম হিসেবে দেখছো! ভাবছো, এতেই বুঝি তুমি স্বস্তি পেয়ে যাবে কিম্বা ঐ মেয়েটাকে অপরাধবোধের সাগরে ভাসিয়ে যাবে! অর্থাৎ, তুমিও মৃত্যুকে লাভ হিসেবেই দেখছো! অথচ বোকা ছেলে, লাভের চেয়ে ক্ষতির ঘরে কি অংক বড়োটা বসছে না? 


মারা গেলে কতোকিছু তুমি মিস করবে ভাবো! ধরো তুমি একজন ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের রোগী, আমি তোমাকেই বলছি, তোমার এখনো ভাবার টাইম আছে। মরে গেলে যে মানুষ দাম পায়, এটা এইসব নাটক-সিনেমার খেল। বাস্তবে এগুলা ফাও। কেউ মৃত মানুষকে মনে রাখে না। জীবিতদের ভীড়ে মৃতদের কোনো পজিশন নেই। এইযে তুমি জাগতিক জীবনযাপন করলে, তুমিই তো জানো মানুষ জীবন নিয়ে কতোটা ব্যস্ত! তুমি তোমার এই ব্যস্ত জীবনে ঠিক কতোবার তোমার প্রিয় কোনো মৃত মানুষকে স্মরণ করো? বা এই স্মরণ করায় সেই মানুষটির ঠিক কী লাভ হয়? 


আচ্ছা ধরে নিলাম, সেই মেয়েটা তোমায় ভাবে। কোনো এক বিকেল বেলায় বারান্দায় বসে সে মূহুর্তখানিক তোমার কথা ভেবে দুঃখ করে। কিন্তু, শ্বশুরের "চা করে দাও" শুনে সে ভাবনা মিলিয়ে যায়। সে তার জীবনে ফিরে যায়। তার এই মূহুর্তখানিকের অনুতাপে তোমার কী আসে যায়! মৃত্যুর পর জাগতিক জীবনে কে তোমাকে নিয়ে কী বললো তাতেও বা কী আসে যায়! এদিকের সাথে তো তোমার সম্পর্ক চোখ বোজার সাথে সাথেই শেষ। 


অথচ, যদি তুমি বেঁচে থাকতে! তুমি কতোগুলো দিনের সূর্য দেখতে পেতে! তুমি কতোগুলো পূর্ণিমা রাতে হাঁটতে পারতে। তুমি দেখতে পেতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে কী-না! তুমি জানতে পারতে, মঙ্গল প্রাণের বাসযোগ্য হয়েছে কী-না। দেখতে পেতে, কতোটা উৎকর্ষ হয়েছে প্রযুক্তির! দেখতে পেতে হুমায়ুনের পর কে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী রাজা! 


শুধু তাই নয়, তোমার একটা সুন্দর সংসার হতো! আচ্ছা বউ ছাড়ো, যদি তুমি ভেবে থাকো আর কাউকে তুমি ভালোবাসতে পারবে না। ভাবো, তোমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হতো! দেখে সবাই বলতো, ঠিক বাবার মতো হয়েছে! সে যে তোমাকে বাবা বলে ডাকতো, সেই ডাক শোনার জন্যও কি তোমার মনে আকুতি হয় না? কেমন মানুষ তুমি? পৃথিবীর আর কোনো আবেগ কি নিজের সন্তানের প্রথম শব্দ শোনার আবেগের চেয়ে তীব্র হয়! 


কীসের আশায় চলে যাচ্ছো ভাই! আরেকটু থাকো! কতো কী দেখো নি! কতো কী শোনো নি! কতো ভালোবাসা এখনো যে তোমার পাওয়ার আছে! কী করে বুঝলে তার চেয়ে বেশি কেউ তোমাকে, আর তোমার চেয়ে বেশি কেউ তাকে ভালোবাসবে না? তুমি কি ভবিষ্যৎ জানো? ভরসা রাখো আল্লাহর ওপর। তিনি জানেন, তুমি জানো না। তাই যা জানো না, তাকে ভালো ভেবে বেঁচে থাকো! জীবন সুন্দর।

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. ওয়ামা তাওফি-ক্বি ইল্লা বিল্লা।

    ReplyDelete