বাবা


বাবাদের কিছু কমন প্রেসক্রিপশন থাকে। যেকোন পরিস্থিতিতে তাঁরা সেটা গছিয়ে দিতে পারেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সবজি খাওয়ার পরামর্শ। যেকোন কিছু হলেই বাবা বলবেন, “শাকসবজি খা বেশি বেশি করে”। একদিন আমি মন খারাপ করে বসে আছি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কী হয়েছে?” বললাম, “পরীক্ষা ভাল হয়নি”। বাবা বলতে লাগলেন, “শাকসবজি তো খাস না। ব্রেইন বাড়বে কী করে?”


আমি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি বেশ সিরিয়াস চেহারা নিয়েই কথাটা বলেছেন। আমি এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম যে, কৌতুক অভিনেতারাও সাধারণত কৌতুক করে হাসেন না। তাই, অডিয়েন্স হিসেবে আমিই হেসে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রত্যুত্তরে চোখ রাঙানো পেয়েছিলাম। 


এরপর একদিন আবার সর্দি হলো আমার, বাবার সামনে যেতেই বাবা সবজি খাওয়ার কথা বলবেন বলবেন এমন সময় পালিয়ে এসেছি। সবজি খেলে সর্দি চলে যাবে এটা শোনার চেয়ে হুমায়ুন আজাদের বই পড়াও ভালো। 


বাবাদের আরেকটা সবচেয়ে কমন প্রেসক্রিপশন হলো, “রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাও, সকালে তাড়াতাড়ি উঠো, তাড়াতাড়ি নাস্তা করো, লাইফের সব সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে”। এই প্রেসক্রিপশন শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। 


অভিষেক উপমন্নু নামের এক কমেডিয়ানের ভিডিওতে শুনেছিলাম তার অভিজ্ঞতা। সে বলছিলো– পরিস্থিতি এমন যে, এখন আমার মনে হয় বাবাকে গিয়ে যদি বলি, “বাবা আমার ক্যান্সার হয়েছে”, তাও তিনি বলবেন, “বাবা সকালে তাড়াতাড়ি উঠে, তাড়াতাড়ি নাস্তা করে দেখোই না আগে, ঠিক হলেও হতে পারে!” 


যাহোক, আজ বাবার একটা শখ নিয়ে কথা বলবো। কম্পিউটার বাবার আজন্ম শখের বস্তু। বুঝতে শেখার পর থেকেই বাবাকে দেখছি, কম্পিউটার নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ তাঁর। আমি কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ি বোধহয় বাবার এই শখের কারণেই। যদিও আমি জোর করে ভর্তি হয়েছি কম্পিউটার সায়েন্সে, কিন্তু যেহেতু বাবার অবসেশন আছে কম্পিউটার নিয়ে, তাই আমার জেদ করাটাও আল্লাহর পরিকল্পনা হতে পারে। 


তো বাবার সাধের কম্পিউটার এলো কিছুদিন আগে। সরকার প্রত্যেক প্রাইমারী স্কুলে ল্যাপটপ দিয়েছে। তো স্কুলের ল্যাপটপ থাকে বাবার দায়িত্বে। ল্যাপটপ পেয়ে তো বাবা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কত যত্ন করে প্রতিদিন বের করছেন, আবার প্যাকেটিং করে রেখে দিচ্ছেন। প্রথম কিছুদিন আমি বাবাকে কয়েকটা কাজ শিখিয়ে দিলাম। ওয়ার্ড ফাইল খোলা-বন্ধ, টাইপ করা–এইসব টুকটাক। বাবা তো মহাখুশি! এখন যখনি উনার রুমের দিকে যাই, দেখা যায়– বাবা পিসির স্ক্রিনে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন আর প্রতি ত্রিশ সেকেন্ড অন্তর এক আঙুল দিয়ে একটা করে অক্ষর টাইপ করছেন।


বাবা যে ল্যাপটপে বসেছেন সেটা আমি অন্য রুম থেকে দিব্যি বুঝতে পারি। সেটা কী করে? তার ক্লিক করার শব্দে। বাবার ধারণা টাচপ্যাডে বা কীবোর্ডে জোরে শব্দ করে ক্লিক না করলে সেটা কাজ করবেনা। একই এনালজি তিনি সুইচের ক্ষেত্রেও খাটান। যদি কখনো এমন হয় যে– কেউ কোনো লাইট বা ফ্যানের সুইচ অন-অফ করেছে অথচ শব্দ হয়নি, বাবা বিদ্যুৎগতিতে এসে হাজির হয়ে যান আর সেটা আবার অন-অফ করিয়ে নেন। যাহোক, আমি আমার রুম থেকে ঠক ঠক করে বাবার ক্লিকের আওয়াজ শুনি আর মনে মনে হাসি। এভাবেই বাবার বেশ চলে যাচ্ছিলো। বাবা এখন অফিশিয়াল কাগজপত্র নিজেই টাইপ করেন। আর মাঝেমাঝে ফেসবুক তো আছেই।


তো সেদিন উপজেলা অফিস থেকে ছাত্রছাত্রীদের তথ্য বিবরণীর এক ওয়ার্ড ফাইল নিয়ে এলেন, সেখানে তাঁকে প্রতিটা নাম এডিট করতে হবে, যেহেতু প্রতিবছর ছাত্রছাত্রী বদলাচ্ছে। বাবা এতদিনে ওয়ার্ডে যে হালকা পাতলা শিখেছেন, সেটা প্রয়োগ করার আনন্দে ডগমগ করতে লাগলেন। 


কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়, ফাইলটা সম্পূর্ণ বিজয়-৫২ সফটওয়্যার দিয়ে টাইপ করা–এহেম এহেম যেহেতু আমাদের মন্ত্রীমশায়ের নির্দেশ! তাই অভ্র সফটওয়্যার দিয়ে এডিট হচ্ছিলো না। বাবা এ নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরে আমি তাঁকে বিজয়ে টাইপ করা শিখিয়ে দিলাম। 


এরপর আমি আমার ছুটি শেষে চলে গিয়েছিলাম মেসে। পরের সপ্তাহে বাসায় এসে দেখি বাবা ফের এক সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। সমস্যাটা হচ্ছে– তিনি ‘ই-কার’, ‘উ-কার’ এসব টাইপ করতে পারছেন কিন্তু ‘ই’ ‘উ’ আনতে পারছেন না। পরে আমি গুগল থেকে বিজয়ে টাইপ করার পদ্ধতি ডাউনলোড করে দিলাম। 


বাবা তো মহাখুশি! আমার পাশে বসেই এডিট করা শুরু করলেন। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললেন, “এতদিন ধরে এটা নিয়ে ঝামেলায় পড়ে ছিলাম। ‘ই’ লিখতে পারছিলাম না এজন্য সব ই এর জায়গায় ‘হ’ লিখে রাখছি আর ‘উ’ এর জায়গায় ‘ড’।" আমি তাকিয়ে দেখি সত্যিই! বাবা ‘মোহাম্মদ উল্যাহ’-কে লিখে রেখেছেন ‘মোহাম্মদ ডল্যাহ’, ‘ইসরাত জাহান’-কে লিখে রেখেছেন ‘হসরাত জাহান’। হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলাম না, কিন্তু বাবা খুব সিরিয়াস এই বিষয়ে তাই চেপে রাখতে হলো।


রাতে খেতে গিয়ে দেখলাম বাবা ক্যালেন্ডারে ফেসবুক কনফার্মেশন কোড আর জিমেইল কনফার্মেশন কোড লিখে রেখেছেন। তিনি বোধহয় ভেবেছেন এই কোডটা পারমানেন্ট। প্রতিবারেই যে পরিবর্তন হয় তা জানতেন না তিনি। এটা দেখে আমার হাসির বদলে চোখ ভরে পানি এল। বাবা রা কেন যে এত সরল হয়! 


#বাবা

–আসিফ মাহমুদ 

–২০১৯ ঈসায়ীতে লেখা।

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.